বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, যা মুক্তিযুদ্ধ নামে পরিচিত, ছিল একটি দীর্ঘ এবং তীব্র লড়াই, যেখানে দেশের অভ্যন্তরীণ এবং বহির্বিশ্বের অসংখ্য মানুষের একক এবং যৌথ প্রচেষ্টা, অজস্র ঘটনা এবং কৌশলগত পদক্ষেপগুলো বিজয়ের পথ প্রশস্ত করেছিল। ১৯৭১ সালের প্রতিটি দিন এই যুদ্ধের ইতিহাসে একটি অনন্য অধ্যায়, যেখানে রাজনৈতিক, কূটনৈতিক এবং সামরিক ঘটনাবলী একসঙ্গে মিলিত হয়ে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে স্বাধীনতার লক্ষ্যকে। এই প্রতিবেদনে আমরা ১০ সেপ্টেম্বরের ঘটনাবলীকে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরব, যেখানে ভারতের সরকারি মহলের স্বাগত, আন্তর্জাতিক কূটনীতি, সাহিত্যিকদের সমর্থন এবং যুদ্ধক্ষেত্রের তীব্র লড়াইয়ের মতো বিভিন্ন দিক অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এই সকল ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের গতিপথকে আরও শক্তিশালী করেছে, যা শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে অবদান রেখেছে।
উপদেষ্টা কমিটির গঠন এবং ভারতের স্বাগত
১০ সেপ্টেম্বর, বাংলাদেশের পাঁচটি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গঠিত একটি উপদেষ্টা কমিটির গঠনকে ভারতের সরকারি মহল থেকে আন্তরিক স্বাগত জানানো হয়। এই কমিটির গঠনকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে চলমান স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি নতুন এবং গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে দেখা হয়। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারক কমিটির চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ বিষয়ে বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ডি. পি. ধর, সঙ্গে পররাষ্ট্র সচিব টি. এন. কাউল, এই দিন প্রথমবারের মতো প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন যে, তারা বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে চলমান আলোচনায় লিপ্ত রয়েছেন। এই আলোচনাগুলো মুক্তিযুদ্ধের সহায়তায় গঠিত উপদেষ্টা কমিটির রাজনৈতিক মূল্যকে অপরিসীম বলে বর্ণনা করা হয়।
এই কমিটির গঠনের ফলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আরও শক্তিশালী রাজনৈতিক ভিত্তি পায়। বিশেষ করে, জাতিসংঘের আসন্ন সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলাদেশের প্রশ্ন উত্থাপনের ক্ষেত্রে এই কমিটির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হবে বলে মনে করা হয়। কারণ, এই কমিটির সদস্যরা বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে কথা বলার পূর্ণ অধিকার রাখবে। এছাড়া, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশের প্রশ্নটি কীভাবে এবং কোন কৌশলে উত্থাপিত হবে, সে বিষয়েও ডি. পি. ধর এবং টি. এন. কাউলের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের নেতাদের মধ্যে বিস্তারিত আলোচনা হয়। এই আলোচনাগুলো মুক্তিযুদ্ধের কূটনৈতিক দিককে আরও সুসংহত করে তোলে, যা ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ককে আরও গভীর করে।
শ্রীলঙ্কায় কূটনৈতিক আলোচনা
এই দিন শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোতে একটি কূটনৈতিক সূত্র সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলে জানায় যে, সিংহল সফররত ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী শ্রীমাভো বন্দরনায়েকের সঙ্গে একান্ত বৈঠকে বাংলাদেশের সমস্যা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। যদিও এই আলোচনার বিষয়বস্তু আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়নি, তবু সূত্রটি নিশ্চিত করে যে, দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান বিরোধীয় বিষয়গুলো, যেমন বাংলাদেশের সংকট, সোভিয়েত-ভারত মৈত্রী চুক্তির তাৎপর্য এবং ভারত মহাসাগরের নিরাপত্তা সংক্রান্ত ইস্যুতে তারা গভীরভাবে কথা বলেছেন।
শ্রীলঙ্কার দৃষ্টিভঙ্গিতে বাংলাদেশের সমস্যা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার হিসেবে দেখা হয়, যেখানে ভারত এটিকে একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা বলে মনে করে। এছাড়া, সোভিয়েত-ভারত চুক্তি সম্পর্কে শ্রীলঙ্কার মনোভাব ছিল যে, এটি এ অঞ্চলে বৃহৎ শক্তির উপস্থিতি বাড়িয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি করবে। এই বৈঠকটি দক্ষিণ এশিয়ার কূটনৈতিক গতিবিধির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ, যা মুক্তিযুদ্ধের আন্তর্জাতিক প্রভাবকে তুলে ধরে।
নেপালে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের কার্যক্রম
নেপাল সফররত তিন সদস্যের বাংলাদেশের সংসদীয় প্রতিনিধিদল এই দিন কাঠমান্ডুতে একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। সংবাদ সম্মেলনে তারা জানান যে, তারা নেপালের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে বিস্তারিত কথোপকথন করেছেন। তবে, কূটনৈতিক কারণে সেইসব আলোচনার বিস্তারিত বিষয়বস্তু তারা প্রকাশ করেননি। এই প্রতিনিধিদলের সফর মুক্তিযুদ্ধের সমর্থন সংগ্রহের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, যা প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার চেষ্টা প্রতিফলিত করে।
অঁদ্রে মালরোর চিঠি এবং সমর্থন
প্রখ্যাত ফরাসি সাহিত্যিক এবং ভাবুক অঁদ্রে মালরো এই দিন একটি গুরুত্বপূর্ণ চিঠিতে পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত বাংলাদেশের জনগণকে ভিয়েতনামের লড়াই থেকে শিক্ষা নিয়ে অনুরূপ জবাব দেওয়ার আহ্বান জানান। এই চিঠিটি লেখা হয় দিল্লিতে ১৮ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিতব্য বাংলাদেশ সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনের প্রস্তুতি কমিটির চেয়ারম্যান এবং সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণকে। চিঠিটির ভাষ্য এই দিন প্রকাশিত হয়, যা মুক্তিযুদ্ধের আন্তর্জাতিক সমর্থনের একটি উজ্জ্বল উদাহরণ। মালরোর এই সমর্থন বাংলাদেশের লড়াইকে বিশ্বব্যাপী সাহিত্যিক এবং বুদ্ধিজীবী মহলে আরও প্রসারিত করে।
উপমহাদেশের বাইরে আন্তর্জাতিক ঘটনাবলী
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্স এই দিন দেশটির কংগ্রেসকে জানান যে, যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তান সরকারকে স্পষ্টভাবে বলেছে যে, বাংলাদেশের শরণার্থীদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে সকল প্রকার চেষ্টা করতে হবে। তিনি কংগ্রেসের কাছে আবেদন জানান যে, পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক সাহায্য দেওয়ার উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া উচিত। এই ঘোষণা মুক্তিযুদ্ধের আন্তর্জাতিক চাপের একটি দিক প্রতিফলিত করে।
সুইডেন সফররত যুক্তরাজ্য এবং বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের দূত আবু সাঈদ চৌধুরী এই দিন দেশটির অ্যাফটনব্লাডেট পত্রিকার খ্যাতনামা সাংবাদিক ফ্রেডারিকসনের সঙ্গে বাংলাদেশ আন্দোলন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেন। ফ্রেডারিকসন স্থানীয় বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটির সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করার আশ্বাস দেন, যা ইউরোপীয় দেশগুলোতে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থন বাড়াতে সাহায্য করে।
ব্রিটেনের পররাষ্ট্র দপ্তর এই দিন জানায় যে, ৫ সেপ্টেম্বর পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশকারী অপারেশন ওমেগা দলের চারজন সদস্যকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে এবং তাদের যশোর জেলে পাঠানো হয়েছে। এই সংবাদ ঢাকার ব্রিটিশ ডেপুটি হাইকমিশন থেকে তাদের কাছে পাঠানো হয়, যা পাকিস্তানের সামরিক শাসনের কঠোরতাকে তুলে ধরে।
পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপ
অবরুদ্ধ বাংলাদেশের সামরিক কর্তৃপক্ষ এই দিন আওয়ামী লীগের ১৪৫ জন এমপিএকে রাষ্ট্রদ্রোহ, অস্ত্রাগার লুণ্ঠন, অননুমোদিত অস্ত্র বিতরণ, রাষ্ট্রবিরোধীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া সহ নানা অভিযোগে সামরিক আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয়। এই নির্দেশ পাকিস্তানের দমনমূলক নীতির একটি প্রতিফলন, যা মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থানকে আরও স্পষ্ট করে।
যুদ্ধক্ষেত্রের ঘটনাবলী
ফেনীর বিলোনিয়ায় পাকিস্তানি বাহিনী মুহুরী নদী পার হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের ওপর প্রচণ্ড কামান আক্রমণ চালায়। এরপর পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়। মুক্তিযোদ্ধারা সারা দিন ধরে যুদ্ধ করে পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম হন, যা তাদের সাহস এবং কৌশলের প্রমাণ।
২ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাঁটিতে মর্টারের আক্রমণ চালান। এতে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা এবং রাজাকার হতাহত হয়, যদিও কিছু বেসামরিক লোকও হতাহত হয়।
এই সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি দল নয়াপাড়ায় পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে আক্রমণ করে। এই আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা তাদের অবস্থান ছেড়ে পেছন দিকে সরে যায়, এবং মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাম্প থেকে কিছু অস্ত্রশস্ত্র দখল করেন।
চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জে আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। তারা দুই দিক থেকে আক্রমণ চালিয়ে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনাকে হতাহত করে।
ময়মনসিংহে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দল কয়েকটি নৌকায় খাদ্যসামগ্রী নিয়ে ভালুকার দিকে এগোলে একদল মুক্তিযোদ্ধা তাদের ওপর আক্রমণ চালান। এতে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা এবং রাজাকার হতাহত হয়।
এই সকল যুদ্ধের ঘটনা মুক্তিযোদ্ধাদের অদম্য সাহস এবং পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে তাদের সফল প্রতিরোধের চিত্র তুলে ধরে, যা মুক্তিযুদ্ধের সামরিক দিককে শক্তিশালী করে।
১০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১-এর এই ঘটনাবলী মুক্তিযুদ্ধের বহুমুখী দিককে প্রতিফলিত করে—রাজনৈতিক কমিটির গঠন থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক সমর্থন এবং যুদ্ধক্ষেত্রের লড়াই। এইসব প্রচেষ্টা একত্রিত হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথকে আরও সুগম করে তুলেছে।
সূত্র:
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর এক, দুই ও এগারো;
স্বাধীনতাসংগ্রামে প্রবাসী বাঙালি, আবদুল মতিন, র্যাডিক্যাল এশিয়া পাবলিকেশনস, লন্ডন;
আনন্দবাজার পত্রিকা ও যুগান্তর, কলকাতা, ভারত, ১১ ও ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১।
মন্তব্য করুন