বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে ১৯৭১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর একটি উল্লেখযোগ্য দিন। এই দিনে বিশ্বের বিভিন্ন কোণ থেকে বাংলাদেশের মানুষের পক্ষে অবস্থান নেওয়া হয়েছে, যা মুক্তিযুদ্ধের বিজয়কে ত্বরান্বিত করতে সাহায্য করেছে। মুক্তিযুদ্ধের পেছনে ছিল দেশি-বিদেশি অসংখ্য মানুষের একক এবং সম্মিলিত প্রচেষ্টা, যা অজস্র ঘটনা এবং উদ্যোগের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এই দিনের ঘটনাবলি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, যা আন্তর্জাতিক সমর্থন, রাজনৈতিক চাপ, এবং মুক্তিবাহিনীর সাহসী অভিযানগুলোকে তুলে ধরে। নিম্নে এই দিনের বিভিন্ন ঘটনা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হলো, যা বাংলাদেশের মানুষের দুর্দশা এবং তাদের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।
অস্ট্রেলিয়ার বুদ্ধিজীবীদের আবেদন: বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থনের একটি মাইলফলক
এই দিনে অস্ট্রেলিয়ার প্রায় ৫০০ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি—যাদের মধ্যে ছিলেন শিক্ষাবিদ, সাংসদ, সাংবাদিক, সাহিত্যিক এবং ধর্মীয় নেতা—একটি যৌথ আবেদনপত্রে স্বাক্ষর করে তাদের দেশের সরকারকে পাকিস্তানকে সাহায্য বন্ধ করার জন্য অনুরোধ জানান। এই আবেদনটি ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আন্তর্জাতিক সমর্থনের একটি শক্তিশালী উদাহরণ, যা দেখায় যে বিশ্বের বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অত্যাচারের বিরুদ্ধে কীভাবে সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন।
তাঁরা অস্ট্রেলিয়া সরকারকে অনুরোধ করেন যাতে পাকিস্তানকে দেওয়া সাহায্য অবিলম্বে বন্ধ করা হয় এবং ভারতে আশ্রয় নেওয়া বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য অর্থসাহায্য বাড়িয়ে ৫০ লাখ ডলার করা হয়। এই অনুরোধগুলোকে তাঁরা সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রচার করেন, যা জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়া, তাঁরা শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য অস্ট্রেলিয়া সরকারকে উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান, যা পাকিস্তানের রাজনৈতিক সমাধানের দিকে চাপ সৃষ্টি করে।
তাঁদের বক্তব্যে উল্লেখ করা হয় যে, পাকিস্তানি সেনাদের বর্বরতা এবং টানা অত্যাচারের কারণে বাংলাদেশের মানুষের বেঁচে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তাঁরা অস্ট্রেলিয়া সরকারকে অনুরোধ করেন যাতে পাকিস্তানকে সেনা সরিয়ে নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আলোচনা শুরু করতে উৎসাহিত করা হয়। এই আবেদনটি শুধুমাত্র অস্ট্রেলিয়ায় নয়, বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের সমর্থনে একটি প্রভাবশালী ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, যা দেখায় যে মুক্তিযুদ্ধ কেবল একটি স্থানীয় যুদ্ধ নয়, বরং একটি মানবিক সংকট যা আন্তর্জাতিক মনোযোগ আকর্ষণ করেছে।
বেগম মুজিবের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান: পাকিস্তানি প্রশাসনের চাপের মুখে সাহসী অবস্থান
এই দিনে বার্তা সংস্থা এপি-র একটি খবরে প্রকাশিত হয় যে, পাকিস্তানি সেনা কর্তৃপক্ষ এবং প্রশাসন শেখ মুজিবুর রহমানের স্ত্রী শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে (বেগম মুজিব) তাঁদের ধানমন্ডির বাড়িতে বসবাস করার জন্য অনুরোধ করেছে। কিন্তু বেগম মুজিব এই অনুরোধ দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষকে জানান যে, তাঁদের "লুটেরারা" বাড়িটির যেসব আসবাব নষ্ট বা লুট করেছে, তার হিসাব তিনি আগে চান। এই প্রত্যাখ্যান ছিল পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে একটি সাহসী অবস্থান, যা বাংলাদেশের নেতৃত্বের অদম্য মনোবলকে প্রতিফলিত করে।
ওই বাড়িটির কিছু দূরে আরেকটি বাড়িতে বেগম মুজিবকে সপরিবার থাকতে দেওয়া হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২৬ জন সেনা দিনরাত সেই বাড়িটির পাহারায় নিয়োজিত ছিল, যা দেখায় যে তাঁরা কড়া নজরদারির মধ্যে ছিলেন। বাড়িটির ফটক এবং যে রাস্তায় বাড়িটি অবস্থিত, তার দুই মুখই বন্ধ করে রাখা হয়, যা তাঁদের স্বাধীনতাকে আরও সীমিত করে দিয়েছে। বেগম মুজিবের দুই ছেলে তখন ভারতে অবস্থান করছিলেন, যখন দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহেনা, ছোট ছেলে রাসেল, জামাই এবং নাতি তাঁর সঙ্গে ছিলেন। এই ঘটনা বাংলাদেশের নেতৃত্বের পরিবারের উপর পাকিস্তানি শাসনের চাপের একটি জ্বলন্ত উদাহরণ, যা মুক্তিযুদ্ধের সময়কার দুর্দশাকে তুলে ধরে।
ভারত-শ্রীলঙ্কা যৌথ ইশতেহার: শরণার্থী সমস্যায় আঞ্চলিক ঐক্য
এই দিনে ভারত এবং শ্রীলঙ্কা বাংলাদেশের শরণার্থী সমস্যার সমাধানকে অত্যন্ত জরুরি বলে একমত হয়। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিংয়ের তিন দিনের শ্রীলঙ্কা সফর শেষে প্রকাশিত একটি যৌথ ইশতেহারে এই মতামত প্রকাশ করা হয়। ইশতেহারে বলা হয় যে, বাংলাদেশ থেকে বিপুলসংখ্যক শরণার্থী ভারতে আসায় সেখানে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সমস্যা উদ্ভূত হয়েছে, যা শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী শ্রীমাভো বন্দরনায়েক লক্ষ করেছেন।
যদিও অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার নীতি সত্ত্বেও, শ্রীলঙ্কা মনে করে যে, পাকিস্তান যদি রাজনৈতিক এবং সাংবিধানিক পদ্ধতিতে চলে, তাহলে শরণার্থীদের ফেরার সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। এই যৌথ ইশতেহার ছিল দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক ঐক্যের একটি উদাহরণ, যা বাংলাদেশের শরণার্থী সংকটকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে তুলে ধরে এবং পাকিস্তানের উপর চাপ সৃষ্টি করে।
জন কেনেথ গলব্রেথের মন্তব্য: বাংলাদেশ সমস্যা অভ্যন্তরীণ নয়
ভারত সফররত যুক্তরাষ্ট্রের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং ভারতে দেশটির সাবেক রাষ্ট্রদূত অধ্যাপক জন কেনেথ গলব্রেথ এই দিনে কলকাতায় একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেন যে, তিনি বাংলাদেশ সমস্যাকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে মনে করেন না। তাঁর মতে, যখন ৮৫ লাখ লোক দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়, তখন এটিকে কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা বলা যায় না। তিনি আরও বলেন যে, যত দিন পূর্ব বাংলার মানুষ স্বশাসনের অধিকার না পাবেন, তত দিন তাঁরা দেশে ফিরে যেতে ভরসা পাবেন না। গলব্রেথের এই মন্তব্য ছিল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে বাংলাদেশের সংকটকে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ, যা পাকিস্তানের নীতিকে চ্যালেঞ্জ করে।
ভুটানের রাজার শরণার্থীশিবির পরিদর্শন: অপ্রত্যাশিত সমর্থন
ভুটানের রাজা জিগমে দর্জি ওয়াংচুক এই দিনে সল্টলেকে একটি শরণার্থীশিবির পরিদর্শন করেন। কোনো পূর্বঘোষণা ছাড়াই এই পরিদর্শন ঘটায় সরকারি মহলে কিছুটা বিস্ময় দেখা দেয়। এই ঘটনা দেখায় যে, ছোট দেশগুলোও বাংলাদেশের শরণার্থী সংকটে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছে, যা আঞ্চলিক সহানুভূতিকে বাড়িয়ে তোলে। রাজার এই উদ্যোগ শরণার্থীদের দুর্দশা সরাসরি দেখে আন্তর্জাতিক সাহায্যের প্রয়োজনীয়তাকে আরও জোরালো করে।
জুলফিকার আলী ভুট্টোর বক্তব্য: পাকিস্তানে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি
পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো এই দিনে করাচিতে বলেন যে, মার্চ মাসের যে ঘটনাবলি পূর্ব পাকিস্তানকে নাড়া দিয়েছে, জাতির প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করলে পশ্চিম পাকিস্তানেও সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে। তিনি জোর দিয়ে বলেন যে, পূর্ণ রাজনৈতিক এবং বাক্স্বাধীনতাই এই সংকটের একমাত্র সমাধান। ভুট্টোর এই বক্তব্য পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে চাপ সৃষ্টি করে এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে প্রভাবিত করে।
পাকিস্তানি মুখপাত্রের স্বীকারোক্তি: মুক্তিযোদ্ধাদের সাফল্য
পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কর্তৃপক্ষের একজন মুখপাত্র এই দিনে স্বীকার করেন যে, গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা পথে পথে মাইন পুঁতে রাখছে এবং রাজাকার ও অন্য আধা সামরিক বাহিনীর ওপর চোরাগোপ্তা আক্রমণ চালাচ্ছে। এই স্বীকারোক্তি মুক্তিবাহিনীর কৌশলগত সাফল্যকে প্রমাণ করে, যা পাকিস্তানি বাহিনীকে দুর্বল করে তোলে।
মুক্তিবাহিনীর অভিযান: সাহসী যুদ্ধ এবং উদ্ধারকার্য
এই দিনে মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন দল সাহসী অভিযান চালায়। ২ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ার কাছে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারবাহী একটি ট্রেন অ্যামবুশ করে, যাতে ট্রেনের চালকসহ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার নিহত হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আরেকটি দল কসবার বগাবাড়ির কাছে অ্যামবুশ করে সেনাদের পিছু হটতে বাধ্য করে। এই সেক্টরের অধীন ফেনীর পরশুরামের কাছে পাকিস্তানি ক্যাম্পে অতর্কিত হামলায় কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।
অন্য একদল গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার থানার কামানদি চরে পাকিস্তানি ক্যাম্পে আক্রমণ চালায়। কয়েক ঘণ্টার যুদ্ধে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত হয় এবং কেউ কেউ ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে যায়। গেরিলারা ক্যাম্পে আটকে রাখা কয়েকজন নারীকে উদ্ধার করে তাদের নিজ নিজ বাড়িতে পৌঁছে দেন। এই অভিযানগুলো মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যুদ্ধের কৌশল এবং মানবিক দিককে তুলে ধরে, যা যুদ্ধের গতিপথ পরিবর্তন করে।
এই ঘটনাবলি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একটি বড় ছবি তুলে ধরে, যা আন্তর্জাতিক সমর্থন এবং অভ্যন্তরীণ সংগ্রামের সমন্বয়কে দেখায়।
সূত্র:
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর দুই
স্বাধীনতাসংগ্রামে প্রবাসী বাঙালি, আবদুল মতিন, র্যাডিক্যাল এশিয়া পাবলিকেশনস, লন্ডন
পূর্বদেশ, ঢাকা, ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
আনন্দবাজার পত্রিকা ও যুগান্তর, কলকাতা, ভারত, ১২ ও ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
মন্তব্য করুন