ঢাকা মঙ্গলবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৫, ২৯ আশ্বিন ১৪৩২
মুক্ত মনমুক্ত চিন্তামুক্তি গাথা

কাটেঙ্গা গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

প্রিয়ভূমি প্রতিবেদক
প্রকাশ : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৪:২৪ পিএম
কাটেঙ্গা গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার ধামালিয়া ইউনিয়নের কাটেঙ্গা গ্রামে সংঘটিত গণহত্যা একটি নৃশংস ঘটনা। এই গণহত্যা দুই পর্বে—৩০ সেপ্টেম্বর এবং ২২ নভেম্বর—সংঘটিত হয়, যাতে বেশ কয়েকজন সাধারণ মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।

কাটেঙ্গা গ্রামের অবস্থান

কাটেঙ্গা গ্রামটি ডুমুরিয়া উপজেলা সদর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে খুলনা ও যশোর জেলার সীমান্তে অবস্থিত। গ্রামের পশ্চিমে ভবদহ নদী, পূর্বে টোলনা এবং দক্ষিণে চেঁচুড়ি গ্রাম অবস্থিত।

মুক্তিযুদ্ধের সময়কার প্রেক্ষাপট

মুক্তিযুদ্ধের সময় ধামালিয়া ইউনিয়ন ছিল মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর প্রভাবাধীন এলাকা। কাটেঙ্গা, টোলনা, চেঁচুড়ি এবং পার্শ্ববর্তী জামিরা বাজারে রাজাকার বাহিনীর দাপট ছিল। এলাকার রাজাকাররা ডুমুরিয়ার উত্তরাঞ্চলে একাধিক গণহত্যা সংঘটিত করে, যার মধ্যে কাটেঙ্গা গ্রামের গণহত্যা অন্যতম। এই গণহত্যা কাটেঙ্গা প্রাইমারি স্কুলের মাঠে দুই দফায় সংঘটিত হয়।

গণহত্যার বিবরণ

প্রথম পর্ব: ৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

কাটেঙ্গা প্রাইমারি স্কুলের পাশে তাগের আলী হালদারের বসতবাড়ি দখল করে রাজাকাররা তাদের ক্যাম্প স্থাপন করেছিল। তারা বিভিন্ন এলাকা থেকে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক যুবকদের ধরে এনে এখানে নির্যাতন করত। ৩০ সেপ্টেম্বর রাতে তারা কয়েকজন যুবককে আটক করে এই বাড়িতে নিয়ে আসে। প্রথমে তাদের ওপর ব্যাপক শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়। পরে গভীর রাতে তাদের স্কুলের মাঠে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। এই গণহত্যায় জামিরা বাজার ক্যাম্পের রাজাকাররাও অংশ নেয়। নিহতদের মধ্যে চেঁচুড়ি গ্রামের ৭ জনের নাম জানা গেছে:

শাহাদাৎ হোসেন গাজী (পিতা: ওসমান গাজী)

আবদুল হাই গাজী (পিতা: হাশেম আলী গাজী)

সাজ্জাদ আকুঞ্জি (পিতা: হাশেম আকুঞ্জি)

আবদুল হামিদ পেয়াদা (পিতা: আছিরউদ্দিন)

কাওছার মোলঙ্গি (পিতা: কেয়ামউদ্দিন মোলঙ্গি)

আমজাদ আকুঞ্জি (পিতা: শরিফুল্লাহ আকুঞ্জি)

জোনাব আলী সরদার (পিতা: মোবারক আলী সরদার)

দ্বিতীয় পর্ব: ২২ নভেম্বর ১৯৭১

দ্বিতীয় দফায় গণহত্যা সংঘটিত হয় ২২ নভেম্বর। এদিন রাজাকাররা বিভিন্ন স্থান থেকে ২৪ জন যুবককে আটক করে। দিনভর নির্যাতনের পর রাতে তাদের কাটেঙ্গা প্রাইমারি স্কুলের মাঠে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। নিহতদের মধ্যে কাটেঙ্গা গ্রামের ১১ জনের নাম জানা গেছে:

মজিদ গাজী (পিতা: কাসেম গাজী)

মোকছেদ ফকির (পিতা: সাহেব আলী)

আহাদ আলী গাজী (পিতা: মদন গাজী)

মোকছেদ গোলদার (পিতা: গোলাম রসুল)

জালাল উদ্দিন গাজী

জব্বার মোল্লা (পিতা: গহর আলী মোল্লা)

সিকান্দার সরদার (পিতা: ফটিক সরদার)

বশির পাশা (পিতা: এবাদ আলী)

লুৎফর সরদার (পিতা: ছবেদ আলী)

কাশেম সরদার (পিতা: ফানেজ সরদার)

রহমান গাজী (পিতা: ছোড়ান গাজী)

গুলিবিদ্ধ হয়েও চেঁচুড়ি গ্রামের জব্বার মোল্লা ও বশির গাজী প্রাথমিকভাবে জীবিত ছিলেন। কিন্তু হাত পিঠমোড়া করে বাঁধা থাকায় তারা পালাতে পারেননি। পরদিন সকালে রাজাকাররা তাদের জামিরা বাজারে নিয়ে খেজুর গাছে বেঁধে গুলি করে হত্যা করে।

লুৎফর সরদারের করুণ পরিণতি

চেঁচুড়ি গ্রামের লুৎফর সরদার (পিতা: ছবেদ আলী সরদার) ছিলেন দরিদ্র পিতা-মাতার একমাত্র সন্তান। রাজাকাররা তাকে তাদের বাহিনীতে যোগ দিয়ে অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নিতে বলেছিল। লুৎফর তাতে রাজি না হওয়ায় রাজাকাররা তাকে কাটেঙ্গা স্কুল মাঠে ধরে নিয়ে যায়। এ সময় তার পিতা-মাতা রাজাকার ও শান্তি কমিটির লোকজনের পায়ে ধরে ছেলের জীবন রক্ষার জন্য মিনতি করেন। রাজাকাররা তাদের আশ্বাস দিয়ে বলে, লুৎফরকে হত্যা করা হবে না, বুঝিয়ে-সুজিয়ে ছেড়ে দেওয়া হবে। আশ্বস্ত হয়ে তার পিতা-মাতা বাড়ি ফিরে যান। কিন্তু রাতে গুলির শব্দ শুনে তারা স্কুল মাঠে ছুটে যান এবং দেখেন লুৎফরের মৃতদেহ পড়ে আছে, চোখ খোলা, মুখ দিয়ে রক্ত ঝরছে। একমাত্র পুত্রের এই বীভৎস মৃত্যু দেখে তার পিতা ছবেদ আলী ও মা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন।

ভবদহ নদীতে হত্যাকাণ্ড

কাটেঙ্গার পার্শ্ববর্তী ভবদহ নদীতেও রাজাকাররা একাধিক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে। মে থেকে নভেম্বর পর্যন্ত খুলনা ও যশোরের বিভিন্ন স্থান থেকে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থকদের ধরে এনে হত্যা করে তাদের লাশ এই নদীতে ফেলে দেওয়া হতো।

আকবর সরদারের হত্যা

চেঁচুড়ি গ্রামের আকবর সরদার নামে একজন যুবককে রাজাকাররা কপালিয়া বাজারে নির্মমভাবে হত্যা করে। মান্দ্রা গ্রাম থেকে তাকে ধরে এনে কপালিয়া বাজারে একটি বকুল গাছে ঝুলিয়ে নির্যাতন করা হয়। প্রহারের পর তার শরীরের বিভিন্ন অংশ ছুরি দিয়ে জখম করা হয়। নির্যাতন ও রক্তক্ষরণে আকবর নিস্তেজ হয়ে পড়েন। এ সময় মসজিদে আজান হচ্ছিল। আকবর শেষবারের মতো নামাজ পড়ার জন্য রাজাকারদের কাছে করুণ মিনতি করেন। কিন্তু তারা তাকে গাছে ঝুলিয়ে গুলি করে হত্যা করে এবং লাশ ভবদহ নদীতে ফেলে দেয়।

অন্যান্য হত্যাকাণ্ড

ডুমুরিয়ার মজিদ বাহিনীর গেরিলা সাইদ হোসেন, আবদুল আলী, এম এম হকসহ অনেককে রাজাকাররা হত্যা করে ভবদহ নদীতে ভাসিয়ে দেয়।

সূত্র

বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ, ২য় খণ্ড

অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

৪ অক্টোবর ১৯৭১: বিনা শর্তে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবি মধ্যপ্রদেশের বিধানসভায়

১ অক্টোবর ১৯৭১: রায়পুরের রাজাকার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গেরিলাদের আক্রমণ

হাসনাবাদ গণহত্যা (নবাবগঞ্জ, ঢাকা)

কাটেঙ্গা গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: ‘পূর্ব বাংলার সমস্যার সমাধান শেখ মুজিবের সঙ্গেই করতে হবে’

২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: “বিদেশি চাপে আমাদের বহু চেষ্টা নস্যাত হয়ে গেছে”

২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: জাতিসংঘে বাংলাদেশ নিয়ে নাটকীয়তা

সাদকপুর গণহত্যা (বুড়িচং, কুমিল্লা)

ফুলদহেরপাড়া গণহত্যা (সরিষাবাড়ী, জামালপুর)

আন্দুলিয়া গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

১০

২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বিজয়ই আমাদের একমাত্র ও চূড়ান্ত গন্তব্য

১১

জুলাই অভ্যুত্থানের প্রতারণা: জনগণের অট্টহাসি ও অবিশ্বাসের প্রতিফলন

১২

২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: চালনা বন্দরে মার্কিন জাহাজ মাইন বিস্ফোরণে ধ্বংস

১৩

বীর উত্তম আবদুস সালেক চৌধুরী: আকাশছোঁয়া হয়ে উঠেছিল যাঁর সাহস

১৪

রামনগর গণহত্যা (রায়পুরা, নরসিংদী)

১৫

২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে ভিয়েতনামের সমর্থন

১৬

মামুদপুর গণহত্যা (গোপালপুর, টাঙ্গাইল)

১৭

ত্রিমোহনী গণহত্যা ও বধ্যভূমি, নেত্রকোনা

১৮

২২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: ঢাকায় প্রাদেশিক মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠক

১৯

চিংড়া গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

২০