ঢাকা মঙ্গলবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১ পৌষ ১৪৩২
মুক্ত মনমুক্ত চিন্তামুক্তি গাথা

১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ের এক ঘটনাবহুল দিন

প্রিয়ভূমি প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৩:২৩ পিএম
১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ের এক ঘটনাবহুল দিন

১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল দিন। এদিন যুদ্ধক্ষেত্রে, কূটনৈতিক ময়দানে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একাধিক নাটকীয় ঘটনা ঘটে, যা বিজয়ের পথকে আরও সুস্পষ্ট করে তোলে।

মানেকশরের শেষ নির্দেশ ও নিয়াজির যুদ্ধবিরতির আরজি

ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল স্যাম মানেকশ এদিন পাকিস্তানি বাহিনীকে শর্তহীন আত্মসমর্পণের জন্য শেষবারের মতো নির্দেশ দেন। এর আগে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ খান নিয়াজী বেলা আড়াইটার দিকে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের কনসাল জেনারেল হার্বাট ডি স্পিভাকের মাধ্যমে দিল্লির যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসে যুদ্ধবিরতির আবেদন পাঠান (কিছু সূত্রে পাকিস্তান দূতাবাসের মাধ্যমে ভারতের কাছে সরাসরি)। নিয়াজির বার্তায় সাক্ষী হিসেবে সই করেন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। দিল্লির যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস সেই বার্তা জেনারেল মানেকশের কাছে পৌঁছে দেয়।

জেনারেল মানেকশ সঙ্গে সঙ্গে বিকেল ৫টা থেকে ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টা পর্যন্ত ঢাকার ওপর বিমান হামলা বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন। যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের মাধ্যমে তাঁর উত্তরে তিনি যুদ্ধবিরতির পরিবর্তে শর্তহীন আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দেন। তিনি স্পষ্ট জানান যে, বিমানবাহিনীর আক্রমণ বন্ধ থাকলেও স্থলবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর অভিযান অব্যাহত থাকবে। ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টার মধ্যে শর্তহীন আত্মসমর্পণ না করলে বিমান হামলা পুনরায় শুরু হবে। আত্মসমর্পণ করলে জেনেভা কনভেনশনের পূর্ণ সুযোগ-সুবিধা প্রদানের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়। ভারতীয় পক্ষ থেকে নিয়াজীকে পাঠানো বার্তায় বিশেষ বেতার কেন্দ্র খোলা এবং কোড নম্বর প্রদানের কথা উল্লেখ করা হয়।

ঢাকার উপকণ্ঠে যৌথ বাহিনীর অগ্রগতি ও সংঘর্ষ

যৌথ বাহিনী (মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনী) এদিন ঢাকার মাত্র দুই মাইলের মধ্যে বিভিন্ন সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে গোলাবর্ষণ শুরু করে। পাকিস্তানি বাহিনী দিনভর পাল্টা গোলাবর্ষণ করে। মেঘনার দক্ষিণ তীরে দাউদকান্দি থেকে নদী পেরিয়ে যৌথ বাহিনী চারদিক থেকে ঢাকাকে ঘিরে ফেলে।

মুক্তিবাহিনী সাভার মুক্ত করলে পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটে ঢাকার প্রবেশপথ মিরপুর সেতুতে (কিছু সূত্রে গাবতলী ব্রিজ) প্রতিবন্ধকতা গড়ে তোলে। রাতে ভারতীয় বাহিনী সাভার থেকে ঢাকার দিকে যাত্রা শুরু করে। কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে টাঙ্গাইল থেকে আগত কাদেরিয়া বাহিনী পথে যোগ দেয়। দিবাগত রাত ২টার দিকে মিরপুর সেতু/গাবতলী ব্রিজের কাছে যৌথ বাহিনী পাকিস্তানি সেনাদের মুখোমুখি হয়। প্রথমে কমান্ডো পদ্ধতিতে আক্রমণ শুরু হয়, পাকিস্তানিরা মুহুর্মুহু গোলাবর্ষণ করে। যৌথ বাহিনীর আরেকটি দল পশ্চিম দিক থেকে যোগ দিলে সারারাত প্রচণ্ড যুদ্ধ চলে।

ঢাকার বাসাবোতে মুক্তিবাহিনীর এস ফোর্স তীব্র আক্রমণ চালায়। চট্টগ্রামে যৌথ বাহিনী শহর থেকে পাঁচ-ছয় কিলোমিটার দূরে পৌঁছে যায়।

বুদ্ধিজীবী হত্যার কালো অধ্যায়

পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক সরকারের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর নির্দেশে এবং পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা মওলানা আবদুল মান্নানের সহযোগিতায় আলবদর বাহিনীর সদস্যরা এদিন প্রখ্যাত চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. আলীম চৌধুরীকে রোগী দেখার কথা বলে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায়। কারফিউ চলাকালে সিদ্ধেশ্বরীর বাসা থেকে তুলে নেওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজের ক্লিনিক্যাল মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ও প্রখ্যাত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মোহাম্মদ ফজলে রাব্বিকে (বিকেলে মাইক্রোবাসে)।

জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ভুট্টোর নাটকীয় ওয়াকআউট

পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূত, পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান ও জাতিসংঘে পাকিস্তানি প্রতিনিধি দলের নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো এদিন নাটকীয়ভাবে খসড়া প্রস্তাবগুলো ছিঁড়ে সদলবল নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশন থেকে ওয়াকআউট করে চলে যান। এর আগে পোল্যান্ডের প্রস্তাবে পাকিস্তানি বাহিনীকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে আত্মসমর্পণ এবং ক্ষমতা বাংলাদেশ সরকারের হাতে হস্তান্তরের কথা বলা হয়; এছাড়া শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির আদেশের প্রস্তাবও ছিল।

ভুট্টো তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে বলেন: “আমি সারেন্ডার ডকুমেন্ট নিয়ে ফিরতে চাই না। আমি একটি আগ্রাসন সমর্থনের ডকুমেন্টকে বৈধতা দিতে পারি না। নিরাপত্তা পরিষদ সম্পূর্ণ ব্যর্থ... আমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাব। কেন আমি নিরাপত্তা পরিষদে সময় নষ্ট করছি? আমি যাচ্ছি। জাতিসংঘে এটাই আমার শেষ আসা। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর যুদ্ধবিরতির খবর আসার সঙ্গে সঙ্গে জরুরি বৈঠক ডাকা হয়েছিল।

বঙ্গোপসাগরে মার্কিন ও সোভিয়েত নৌবহরের মুখোমুখি

যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এদিন পারমাণবিক শক্তিচালিত বিমানবাহী রণতরি ইউএসএস এন্টারপ্রাইজের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহরের একাংশ বঙ্গোপসাগরে উপস্থিত হয়। বহরে ছিল হেলিকপ্টারবাহী জাহাজ ত্রিপোলি (২৩টি হেলিকপ্টারসহ), ডেস্ট্রয়ার এবং উপকূলীয় অবতরণযান। প্রথমে বলা হয় মার্কিন নাগরিক উদ্ধারের জন্য, পরে পাকিস্তানি বাহিনী ও বিহারিদের সরিয়ে নেওয়ার কথা বলা হয়।

পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে ভারতীয় নৌবাহিনীর সহযোগিতায় ২০টি সোভিয়েত রণতরি (ক্ষেপণাস্ত্রবাহী ফ্রিগেড ও ডুবোজাহাজসহ) ভারত মহাসাগরে জড়ো হয়। এতে সপ্তম নৌবহর দিক পরিবর্তন করে।

অন্যান্য আন্তর্জাতিক উন্নয়ন

আন্তর্জাতিক রেড ক্রস কমিটি জেনেভা থেকে বিবৃতি দিয়ে জানায়, লড়াইয়ে অংশ না নেওয়া ব্যক্তিরা ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে আশ্রয় নিতে পারবেন। বাংলাদেশ সরকার একতরফাভাবে ঘোষণা করে যে, জাতিসংঘের সদস্য না হলেও তারা জাতিসংঘ সনদ, জেনেভা চুক্তি ও মানবাধিকার সনদকে পূর্ণ সম্মান দেবে।

দেশব্যাপী মুক্তি ও আত্মসমর্পণ

  • চট্টগ্রামে লেফটেন্যান্ট শওকত, ক্যাপ্টেন গফফার (চতুর্থ বেঙ্গল) ও ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের (১০ ইস্ট বেঙ্গল) নেতৃত্বে হাটহাজারীতে হানাদাররা (মেজর হাদীর নেতৃত্বে) আত্মসমর্পণ করে; চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় মুক্ত হয়।
  • লেফটেন্যান্ট দিদারের নেতৃত্বে কুমিরা ঘাঁটিতে আক্রমণ, পরে ফৌজদারহাটে পৌঁছে মিত্রবাহিনীর সহায়তায় পুনরাক্রমণ।
  • সন্ধ্যায় ভাটিয়ারীতে ব্যাপক সংঘর্ষ।
  • রংপুর শহর ঘিরে ফেলা হয়; হানাদাররা সন্ধ্যায় যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব দেয়।
  • গাজীপুর হানাদারমুক্ত; টঙ্গী-ছয়দানায় আক্রমণে প্রচুর হানাদার নিহত ও অস্ত্র ধ্বংস।
  • খাগড়াছড়ি মুক্ত; এসডিও বাংলোতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন।
  • মেজর আইনউদ্দিনের নেতৃত্বে ময়নামতি সড়কে ১৫০ হানাদার আত্মসমর্পণ।
  • খুলনায় কমান্ডার এম আরেফিন (নদীপথ) ও মেজর জয়নাল আবেদীন (সড়কপথ) আক্রমণ; ফুলতলায় বিমান হামলায় হানাদাররা পালায়।
  • বগুড়া ক্যান্টনমেন্টে ১,৭০০ হানাদার অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ।
  • ফরিদপুরের কামারখালীতে আক্রমণে হানাদাররা পালিয়ে মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ।
  • সিলেটে খাদিমগর ঘাঁটি ঘিরে ফেলা; হাবিলদার গোলাম রসূল শহীদ।
  • মেজর শাফায়াত জামিলের ৪ কোম্পানি গোবিন্দগঞ্জ-বিশ্বনাথ দখল; ক্যাপ্টেন নবীর দল রাধানগর-গোয়াইঘাট দখল; হানাদাররা পালাতে শুরু করে।

তথ্যসূত্র:

স্মৃতি ’৭১, সম্পাদনা রশীদ হায়দার, বাংলা একাডেমি।

আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ভারত, ১৬ ও ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র পঞ্চম, দশম, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড।

দৈনিক পাকিস্তান, ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১।

দৈনিক যুগান্তর, ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১।

অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মহান বিজয় দিবস: গৌরবের দিনে প্রশ্নের ছায়া

১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ের এক ঘটনাবহুল দিন

পরের নোবেলটি কার? ইউনুস না শফিক?

এই পতাকা কাদের? / কে চেয়েছে এই পতাকা???

এখন আমাদের ত্রাণকর্তা কে? / ইউনুস, ডোভাল না রজার???

৪ অক্টোবর ১৯৭১: বিনা শর্তে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবি মধ্যপ্রদেশের বিধানসভায়

১ অক্টোবর ১৯৭১: রায়পুরের রাজাকার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গেরিলাদের আক্রমণ

হাসনাবাদ গণহত্যা (নবাবগঞ্জ, ঢাকা)

কাটেঙ্গা গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: ‘পূর্ব বাংলার সমস্যার সমাধান শেখ মুজিবের সঙ্গেই করতে হবে’

১০

২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: “বিদেশি চাপে আমাদের বহু চেষ্টা নস্যাত হয়ে গেছে”

১১

২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: জাতিসংঘে বাংলাদেশ নিয়ে নাটকীয়তা

১২

সাদকপুর গণহত্যা (বুড়িচং, কুমিল্লা)

১৩

ফুলদহেরপাড়া গণহত্যা (সরিষাবাড়ী, জামালপুর)

১৪

আন্দুলিয়া গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

১৫

২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বিজয়ই আমাদের একমাত্র ও চূড়ান্ত গন্তব্য

১৬

জুলাই অভ্যুত্থানের প্রতারণা: জনগণের অট্টহাসি ও অবিশ্বাসের প্রতিফলন

১৭

২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: চালনা বন্দরে মার্কিন জাহাজ মাইন বিস্ফোরণে ধ্বংস

১৮

বীর উত্তম আবদুস সালেক চৌধুরী: আকাশছোঁয়া হয়ে উঠেছিল যাঁর সাহস

১৯

রামনগর গণহত্যা (রায়পুরা, নরসিংদী)

২০