

ইতিহাস সাক্ষী, কোনো জাতিকে যদি পঙ্গু করে দিতে হয়, তবে সবার আগে তার সংস্কৃতিকে হত্যা করো। গত এক বছরে বাংলাদেশে যা ঘটছে, তাকে কেবল ‘বিশৃঙ্খল মব ভায়োলেন্স’ বললে সত্যের অপলাপ হবে। এটি একটি সুপরিকল্পিত ‘সাংস্কৃতিক গণহত্যা’। বাউলদের একতারা ভাঙা থেকে শুরু করে ছায়ানটের শিশুদের অঙ্কন খাতা পুড়িয়ে দেওয়া—সবই একই সুতোয় গাঁথা এক বিষাক্ত নীল নকশা। আমরা কি তবে নিঃশব্দে আফগানিস্তান কিংবা সিরিয়ার মতো এক মধ্যযুগীয় অন্ধকারের দিকে হেঁটে যাচ্ছি?
বাউলের রক্তে ভেজা মাটি
বাউল ও সুফি দর্শন এই জনপদের রক্ষাকবচ। কিন্তু গত এক বছরে সেই রক্ষাকবচকে ছিন্নভিন্ন করা হয়েছে। অন্তত ১০০টি মাজার গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে 'তৌহিদী জনতা'র ছদ্মবেশে। সিরাজগঞ্জ থেকে গাজীপুর, ঠাকুরগাঁও থেকে খুলনা—সর্বত্রই লালনের উত্তরসূরিদের ওপর নেমে এসেছে পাশবিক নির্যাতন। একজন বাউল শিল্পীর ধর্ম অবমাননার কথিত অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া এবং তাঁর মুক্তির দাবিতে আয়োজিত মানববন্ধনে উগ্রবাদীদের হামলা প্রমাণ করে যে, এই দেশে এখন যুক্তির চেয়ে তলোয়ারের ধার বেশি। যখন একজন বাউলের চুল কেটে দেওয়া হয় কিংবা তাঁর একতারা ভেঙে ফেলা হয়, তখন আসলে বাঙালির হাজার বছরের সহনশীলতার মেরুদণ্ডটাই ভেঙে দেওয়া হয়।
ছায়ানট-উদীচী: বাতিঘর নেভানোর উৎসব
২০২৫ সালের ডিসেম্বর মাসটি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে এক কলঙ্কিত অধ্যায় হয়ে থাকবে। ধানমন্ডির ছায়ানট ভবন এবং উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর কার্যালয়ে যারা আগুন দিয়েছে, তারা আসলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনায় আগুন দিয়েছে। উদীচীর কেন্দ্রীয় কার্যালয় আজ কেবল পোড়া স্তূপ। কিন্তু তার চেয়েও ভয়াবহ হলো ছায়ানটের ‘নালন্দা’ উচ্চ বিদ্যালয়ের ধ্বংসলীলা।
একটি রাষ্ট্র কতটা দেউলিয়া হলে শিশুদের আঁকা ছবি, তাদের পাঠাগার আর বাদ্যযন্ত্র পুড়িয়ে দেওয়া যায়? যারা শিশুদের সুর আর রঙের জগতকে পুড়িয়ে অঙ্গার করতে পারে, তারা আর যাই হোক মানুষের কাতারে পড়ে না। ইউনুস সরকারের এই রহস্যজনক নীরবতা কি তবে অপরাধীদের আশকারা দিচ্ছে না? ড. ইউনুস যখন আন্তর্জাতিক মঞ্চে মানবাধিকারের কথা বলেন, তখন দেশের অভ্যন্তরে বাঙালির সাংস্কৃতিক বাতিঘরগুলো ভস্মীভূত হওয়া কি এক চরম কৌতুক নয়?
জেমসের মঞ্চে ইটপাটকেল: তারুণ্যের টুঁটি চেপে ধরা
ফরিদপুরে জেমসের কনসার্টে হামলা কোনো সাধারণ বিশৃঙ্খলা নয়। এটি তরুণ প্রজন্মকে ঘরবন্দি করার এক মহড়া। জেমস কেবল একজন শিল্পী নন, তিনি কয়েক প্রজন্মের তারুণ্যের প্রতীক। তাঁর মঞ্চে যারা ইটপাটকেল ছোড়ে, তারা আসলে মুক্তচিন্তার ওপর পাথর নিক্ষেপ করে। বসন্ত উৎসব বন্ধ করা, ভ্যালেন্টাইনস ডের দোকান ভাঙচুর করা আর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সঙ্গীত শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ করা—এগুলো প্রমাণ করে যে আমাদের মগজে উগ্রবাদের বিষবাষ্প ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
গন্তব্য যখন অন্ধকার
আফগানিস্তানে তালেবানরা ঠিক এভাবেই শুরু করেছিল। প্রথমে মাজার ভাঙা, তারপর বাদ্যযন্ত্র পোড়ানো, তারপর শিল্পীদের দেশছাড়া করা—পরিশেষে পুরো দেশটাকে একটা জেলখানায় রূপান্তর করা। বাংলাদেশের বর্তমান চিত্র সেই ভয়াবহ ভবিষ্যতেরই পূর্বাভাস। যখন বাউলদের 'অশ্লীল' বা 'হারাম' বলে গালি দেওয়া হয়, তখন বুঝতে হবে এই সমাজ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছে।
সাংস্কৃতিক দেউলিয়াপনা যখন রাষ্ট্রকে গ্রাস করে, তখন সেখানে আর গণতন্ত্র থাকে না; থাকে কেবল ফতোয়াবাজি আর বিচারহীনতার সংস্কৃতি। যারা আজ ক্ষমতার আড়ালে বসে এই ‘সংস্কৃতি বিরোধী ফ্যাসিবাদের’ চাষ করছেন, তারা মনে রাখবেন—ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না।
প্রতিরোধের আগুন জ্বলুক
এখন আর সময় নেই দীর্ঘশ্বাস ফেলার। নীরবতা মানেই এই ধ্বংসযজ্ঞে আপনার মৌন সম্মতি। আমাদের শৈশব পুড়ছে, আমাদের গান পুড়ছে, আমাদের পরিচয় পুড়ছে। ছায়ানটের পোড়া দেয়াল আমাদের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুড়ছে—আমরা কি এতটাই মেরুদণ্ডহীন হয়ে গেছি?
মন্তব্য করুন