মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ১ অক্টোবর একটি গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল দিন। এদিন আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশ প্রশ্ন নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়, মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা অব্যাহত থাকে এবং দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ তীব্রতর হয়। নিউইয়র্কের চার্চ সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ দূত ও বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতা বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশ প্রশ্নের মীমাংসায় তিনটি শর্ত অপরিহার্য: বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তি দেওয়া এবং ইয়াহিয়ার দখলদার বাহিনীকে বাংলাদেশ থেকে অপসারণ করা। এই শর্তগুলো পূরণ না হলে কোনো রাজনৈতিক সমাধান বাংলাদেশের জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। তিনি আরও জানান, এই শর্তগুলো নিয়ে কোনো আলোচনা চলতে পারে না এবং ইয়াহিয়ার সঙ্গে সমাধানে পৌঁছানোর কোনো আশা নেই।
এদিকে, জাতিসংঘ পাকিস্তানের আপত্তির কারণে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের লাউঞ্জে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে। সাংবাদিক ও দর্শনার্থীদের প্রবেশেও কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি আগা শাহী কয়েক দিন আগে এ বিষয়ে লিখিত আপত্তি জানিয়েছিলেন।
ঢাকায় ঘটনা
ঢাকায় জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে উপনির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং এতে সভাপতিত্ব করেন শান্তি কমিটির নেতা পীর মোহসেনউদ্দিন।
এপিপিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রাদেশিক সমবায়, মৎস্য ও সংখ্যালঘুমন্ত্রী আউং শু প্রু বলেন, দেশের সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার করা হচ্ছে বলে ভারত যে প্রচারণা চালিয়েছে, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা তাদের জানমালের নিরাপত্তা বিধান করছে।
চীনের ২২তম জাতীয় দিবস উপলক্ষে ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত চ্যাং ইং বলেন, বহিরাগত কোনো অপশক্তি যদি পাকিস্তানে আক্রমণ করে, তাহলে পাকিস্তান ও চীন তার যথাযথ জবাব দেবে। চীন সব সময় পাকিস্তানের পাশে আছে। অনুষ্ঠানে প্রাদেশিক মন্ত্রিসভার মন্ত্রীরাসহ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজী উপস্থিত ছিলেন।
দিল্লির পাকিস্তান হাইকমিশনের কর্মী আবদুশ শহীদ এদিন হাইকমিশনের দেয়াল টপকে পালিয়ে বাংলাদেশ মিশনে এসে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন।
ভারতে ঘটনা
ভারত সফররত সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগোর্নি দিল্লিতে বলেন, ভারতের সঙ্গে বর্তমান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অক্ষুণ্ন রেখে বাংলাদেশ প্রশ্নের সমাধানে তাঁর দেশ সম্ভাব্য সব রকম সাহায্য করবে। ভারত উপমহাদেশের বিপজ্জনক পরিস্থিতির দিকে সোভিয়েত জনগণ বিশেষ নজর রেখেছে। তাঁর সম্মানে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরির দেওয়া ভোজসভায় তিনি এ কথা বলেন। তিনি আরও বলেন, উপমহাদেশের জনগণের আইনসংগত অধিকার ও স্বার্থের দিকে লক্ষ রেখে যুক্তিযুক্ত রাজনৈতিক সমাধানের জন্য সম্ভাব্য সব সহযোগিতা প্রদান করবে সোভিয়েত ইউনিয়ন। ভোজসভায় ভি ভি গিরি বলেন, পূর্ব বাংলা থেকে ভারতে আরও শরণার্থী আগমন বন্ধ করা একান্ত দরকার। পূর্ব বাংলায় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অস্তিত্ব ও কর্তৃত্বকে পাশ কাটিয়ে কোনো বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়া হলে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হবে।
পদগোর্নি হ্যানয় যাওয়ার পথে একদিনের সফরে দিল্লি আসেন এবং তাঁকে অভ্যর্থনা জানান রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি। দিল্লির বাংলাদেশ মিশনের কে এম শেহাবউদ্দিন ও আমজাদুল হকের নেতৃত্বে মিশনের কর্মী ও সমর্থকরা বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন।
দিল্লির এক কূটনৈতিক সূত্র জানায়, সোভিয়েত ইউনিয়ন শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য চেষ্টা করছে। তবে দিল্লির কূটনৈতিক মহল মনে করে যে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ওপর চাপ দিয়ে কাজ হবে না।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারণী কমিটির চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ বিষয়ক দায়িত্বপ্রাপ্ত ডি পি ধর মস্কো থেকে লন্ডন যাত্রা করেন। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সোভিয়েত সফর-সম্পর্কিত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য তিনি গত সপ্তাহে মস্কো গিয়েছিলেন। ইন্দিরা গান্ধী চলে যাওয়ার পরও তিনি সোভিয়েত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেন। লন্ডন যাত্রার আগে তিনি দক্ষিণ রাশিয়া বিভাগের মন্ত্রী এ এ কোমিভের সঙ্গে আলোচনা করেন।
আন্তর্জাতিক মহলে ঘটনা
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্স নিউইয়র্কে পাকিস্তান-ভারত সম্পর্কের অবনতি নিয়ে ব্রিটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার অ্যালেক ডগলাস হোমের সঙ্গে বৈঠক করেন। ভারতে ব্যাপকহারে বাংলাদেশি শরণার্থী আসার ফলে উপমহাদেশে শান্তি বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কায় তাঁরা উদ্বেগ প্রকাশ করেন। একই দিনে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে সংবাদ সম্মেলনে অ্যালেক ডগলাস হোম বলেন, পাক-ভারত পরিস্থিতি গুরুতর রূপ নিয়েছে এবং অচিরেই নিরসন হবে বলে মনে হয় না। ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে গেরিলা তৎপরতা ও নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে তাঁরা শঙ্কিত। সম্প্রতি কয়েকটি রিলিফবাহী জাহাজের ক্ষতি করা হয়েছে, ফলে শিপিং ব্যবস্থায় স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে জাতিসংঘকে কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে। সন্ধ্যায় তিনি জাতিসংঘে যোগ দেওয়া পাকিস্তানি প্রতিনিধিদলের নেতা মাহমুদ আলীর সঙ্গে দেখা করেন।
সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা প্রাভদায় ভারতে আসা শরণার্থী ও বাংলাদেশের দুঃসহ পরিস্থিতি নিয়ে নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। এ ছাড়া সোভিয়েত শান্তি কমিটির বিবৃতি এবং ট্রেড ইউনিয়ন ও কারখানার শ্রমিকদের বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। বিবৃতিতে পূর্ব বাংলার জনগণ ও তাদের নেতাদের বিরুদ্ধে উৎপীড়নমূলক ব্যবস্থা বন্ধ করার জন্য পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। মস্কোর কূটনৈতিক মহল জানায়, এ থেকে স্পষ্ট যে সোভিয়েত সরকার বাংলাদেশের ব্যাপারে গণমাধ্যমে পালিত সতর্কতা থেকে সরে এসেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া পাকিস্তানি ছাত্রদের সঙ্গে বৈঠক করেন জামায়াত নেতা এ টি সাদী। বৈঠকে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের 'বিচ্ছিন্নতাবাদীদের' বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার জন্য ছাত্রদের প্রতি আহ্বান জানান।
দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ
মুক্তিবাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের একদল নৌ কমান্ডো চট্টগ্রাম বন্দরে মাইনের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে একটি গ্রিক ট্যাঙ্কার ডুবিয়ে দেয়। বাংলাদেশ সরকারের এক মুখপাত্র জানান, সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলে নৌ গেরিলাদের তৎপরতায় বিদেশি জাহাজের নাবিকরা চট্টগ্রাম বন্দর ও খুলনার চালনা বন্দরে জাহাজ ভেড়াতে সাহস পাচ্ছে না। ২১ সেপ্টেম্বর মুক্তিবাহিনীর নৌ গেরিলারা একটি পাকিস্তানি জাহাজের ব্যাপক ক্ষতি করে। ঢাকাতেও পাকিস্তানি সেনারা দল না বেঁধে বাইরে যেতে পারছে না।
নওয়াবগঞ্জে মুক্তিবাহিনী হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং সমগ্র নওয়াবগঞ্জ থানা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়। যুদ্ধে কয়েকজন হানাদার সেনা নিহত হয় এবং ৩০ জন হানাদার ও রাজাকার আহত হয়।
ময়মনসিংহের ভালুকা, কাশীগঞ্জ ও ত্রিশাল থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর তিনটি দল বাইন্দা ও বড়াইদ এলাকায় অগ্রসর হলে আফসার বাহিনীর কোম্পানি কমান্ডার কাশেমের নেতৃত্বে কছিমউদ্দিন, মনেরউদ্দিন ও হাফিজুর রহমানের মুক্তিবাহিনী পথরোধ করে। প্রায় ১৭ ঘণ্টার যুদ্ধে ৭১ জন হানাদার সেনা ও রাজাকার নিহত হয় এবং অসংখ্য আহত হয়।
বগুড়ার সুকানপুর রেলস্টেশনে রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর হামলা চালালে মুক্তিবাহিনী প্রতিরোধ গড়ে তোলে। পরে হানাদার বাহিনী যোগ দিলে প্রায় ৬ ঘণ্টার যুদ্ধে ২০ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং ২০ জনকে আটক করা হয়। হানাদাররা গ্রামবাসীদের ওপর গণহত্যা চালিয়ে বহু মানুষকে শহীদ করে।
চট্টগ্রামের দুর্গাপুর হাইস্কুলের রাজাকার ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করে কয়েকজন রাজাকারকে নিহত করে এবং ৭টি রাইফেল দখল করে।
ফেনীর ফুলগাজীর মুন্সিরহাটে মুক্তিবাহিনী হানাদার ক্যাম্পে হামলা চালিয়ে কয়েকজন সেনা নিহত করে।
লক্ষ্মীপুরের রায়পুরের রাজাকার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গেরিলারা আক্রমণ করে কয়েকজন রাজাকারকে হত্যা করে।
মৌলভীবাজারের কুমারসাইল চা বাগানের কাছে মুক্তিবাহিনী হানাদার টহল দলের ওপর আক্রমণ চালিয়ে কয়েকজন সেনা নিহত করে।
৮ নং সেক্টরের গোজাডাঙ্গা সাব-সেক্টরে মুক্তিবাহিনী ভারুখালীতে হানাদারদের ওপর হামলা চালিয়ে ৪ জন সেনা নিহত করে।
সিলেটের পুট্টিছড়ায় মুক্তিবাহিনী হানাদার ক্যাম্পে হামলা চালিয়ে ৩ জন সেনা নিহত করে এবং ১ জনকে আহত করে।
৫ নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা মুরাবস্তিতে হানাদার অবস্থানে আক্রমণ করে ২টি বাঙ্কার ধ্বংস করে, কিন্তু ওয়ারলেস সেট নষ্ট হওয়ায় পিছু হটে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় মুক্তিবাহিনীর ৪১ সদস্যের গেরিলা দল ঢাকার উদ্দেশে রওনা হলে শাহ সেতুর কাছে হানাদাররা হামলা চালায়। এতে ৫ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন, ৩ জন আহত হন এবং ১৫টি রাইফেল ও ৫টি স্টেনগান হারানো যায়।
নোয়াখালী সদর মহকুমাকে ৪ ভাগে বিভক্ত করে দায়িত্ব দেওয়া হয়: দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে সুবেদার মেজর লুৎফর রহমান, পূর্ব-দক্ষিণে সুবেদার ওয়ালীউল্লাহ, পূর্ব-উত্তরে নায়েক সুবেদার শামসুল হক এবং পশ্চিম-উত্তরে নায়েক সুবেদার ইসহাক।
নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে ১১ নং সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন মতিয়ার রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা থানা আক্রমণ করে দখল করে নেয়।
কুমিল্লা অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধারা লালমাই-সোনাগাজী সড়কের পেপুলিয়া বাজারের কাছে ডিনামাইট লাগিয়ে একটি সেতু উড়িয়ে দেয়।
সূত্র
- মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালি: যুক্তরাজ্য, আবদুল মতিন, সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা।
- দ্য টেলিগ্রাফ, যুক্তরাজ্য, ১ অক্টোবর ১৯৭১।
- আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ভারত, ২ ও ৩ অক্টোবর ১৯৭১।
- বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র ষষ্ঠ, দশম, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড।
- দৈনিক পাকিস্তান, ২ অক্টোবর ১৯৭১।
- দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা, ২ অক্টোবর ১৯৭১।
- দৈনিক আনন্দবাজার, ২ অক্টোবর ১৯৭১।
মন্তব্য করুন