ঢাকা মঙ্গলবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৫, ২৯ আশ্বিন ১৪৩২
মুক্ত মনমুক্ত চিন্তামুক্তি গাথা

চিংড়া গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

প্রিয়ভূমি প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৩:৪৫ পিএম
চিংড়া গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় চিংড়া গণহত্যা সংঘটিত হয় ২০ ও ২১ সেপ্টেম্বর। এতে ৭ জন নিরীহ মানুষ প্রাণ হারান। ডুমুরিয়া সদরের পশ্চিম-দক্ষিণ দিকে ভদ্রা নামে একটি খরস্রোতা নদী প্রবাহিত ছিল। ডুমুরিয়া সদরের বাজারের কাছে এনজিসি এন্ড এনজিকে হাইস্কুলের পশ্চিম পাশ ঘেঁষে এই নদী বয়ে যেত। ভদ্রা নদীর পশ্চিম তীরে শোভনা ইউনিয়নের চিংড়া গ্রাম অবস্থিত। এই গ্রামে স্থানীয় রাজাকাররা গণহত্যা সংঘটিত করে। দীর্ঘদিন ধরে নদীটি মৃতপ্রায় ছিল, কিন্তু সম্প্রতি (২০১৮ সালে) খননের মাধ্যমে এটি আবার সচল হয়েছে। স্কুল সংলগ্ন এই নদীর চরে রাজাকাররা এই গণহত্যা চালায়।

ডুমুরিয়া থানা ভবনের পূর্ব পাশে ছিল এনজিসি এন্ড এনজিকে হাইস্কুলের ছাত্রাবাস। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে এই ছাত্রাবাসটি দখল করে রাজাকাররা সেখানে ক্যাম্প স্থাপন করে। রাজাকারদের আরেকটি ক্যাম্প ছিল থানা ভবনের পশ্চিম পাশে মজিদ মোল্লার বাড়ি সংলগ্ন একটি ভবনে। এই ক্যাম্পের পশ্চিম পাশে ভদ্রা নদী এবং তার পশ্চিম তীরে চিংড়া গ্রাম। ডুমুরিয়া সদর এলাকায় রাজাকারদের প্রভাব থাকলেও, চিংড়া গ্রামসহ শোভনা ইউনিয়ন ছিল মজিদ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। এই বাহিনী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সশস্ত্র লড়াইয়ে লিপ্ত ছিল। শেখ আবদুল মজিদ ছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল)-এর খুলনা জেলার সাধারণ সম্পাদক। এই দলটি মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নিলেও, শেখ মজিদ তাঁর পার্টির সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে একটি শক্তিশালী বাহিনী গড়ে তোলেন। ডুমুরিয়া উপজেলায় পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে মজিদ বাহিনী অনেক সফল অভিযান পরিচালনা করে। ডুমুরিয়ার রাজাকারদের মধ্যে আকব্বর শেখ, ইউসুফ (ইছো) মুন্সী, আতিয়ার শেখ প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।

৫ সেপ্টেম্বর মজিদ বাহিনী শোভনা ইউনিয়নের পার্শ্ববর্তী ঝিলা নদীতে রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনাদের একটি সশস্ত্র লঞ্চ ডুবিয়ে দেয়। এই ঘটনার পর থেকে পাকিস্তানি বাহিনী শোভনা এলাকায় অভিযান জোরদার করে। ৮ সেপ্টেম্বর থেকে শোভনা ইউনিয়নের পার্শ্ববর্তী নদীতে চারটি লঞ্চ ও গানবোটে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী টহল দেওয়া শুরু করে। এছাড়া রাজাকাররা শোভনা ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় মজিদ বাহিনীর যোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সমর্থকদের বিরুদ্ধে হামলা চালাতে থাকে। চিংড়া গ্রাম ডুমুরিয়া সদরের পাশে অবস্থিত হওয়ায় এই গ্রামেও রাজাকাররা তৎপর হয়ে ওঠে।

১০ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী শোভনা গ্রামে হানা দিয়ে বিভিন্ন বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে এবং ব্যাপক গোলাগুলি চালায়। এই ঘটনায় এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। মজিদ বাহিনী তখন শোভনা এলাকা ছেড়ে পার্শ্ববর্তী মাগুরখালী ইউনিয়ন ও অন্যান্য এলাকায় আশ্রয় নেয়। এই বাহিনীর অন্যতম যোদ্ধা ছিলেন চিংড়া গ্রামের শেখ আমজাদ হোসেন। চিংড়া গ্রামের অধিবাসীরা তাঁর কাছে গিয়ে তাদের করণীয় সম্পর্কে জানতে চায়। এই সময়ে ডুমুরিয়ার রাজাকাররা চিংড়ার অধিবাসীদের আশ্বাস দেয় যে, তারা গ্রামে আক্রমণ করবে না, তবে মজিদ বাহিনীর কেউ গ্রামে থাকলে তাকে আত্মসমর্পণ করতে হবে। পরিস্থিতি বিবেচনায় আমজাদ হোসেনও সম্মতি দিয়ে বলেন যে, কেউ কাউকে আর আক্রমণ করবে না। এই প্রস্তাবে সম্মত হলে চিংড়া গ্রামের অধিবাসীরা রাজাকারদের প্রস্তাব মেনে নেয়।

পরদিন সকালে ডুমুরিয়া সদরের রাজাকাররা নৌকায় পাকিস্তানি পতাকা উড়িয়ে নদী পার হয়ে চিংড়া গ্রামে হাজির হয়। আগের দিন পরস্পরকে আক্রমণ না করার সমঝোতা হওয়ায় মজিদ বাহিনীর সক্রিয় সদস্য মোহর আলী ফকির, আবদুল গফুর, জফর আলী প্রমুখ গ্রামেই ছিলেন। রাজাকাররা গ্রামে এসে সকলকে উত্তর চিংড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয়। এই খবর পেয়ে গ্রামের অনেক অধিবাসী সেখানে উপস্থিত হয়। তারা ভেবেছিল, রাজাকাররা হয়তো গ্রামবাসীদের কোনো নির্দেশনা দিতে চায়।

চিংড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে উপস্থিত হওয়ার পর রাজাকাররা অস্ত্রের মুখে গ্রামবাসীদের মধ্য থেকে প্রায় ২০ জনকে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলে। পরে তাদের নৌকায় করে নদী পার করিয়ে থানা সংলগ্ন রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে সপ্তাহ খানেক রেখে তাদের ওপর নির্মম নির্যাতন করা হয়। এর মধ্যে বেশ কয়েকজনকে নির্যাতন করে ছেড়ে দেওয়া হয়। শেষপর্যন্ত ৭ জন তাদের হাত থেকে মুক্তি পায়নি। ২০ সেপ্টেম্বর রাতে রাজাকাররা এদের স্কুলের পশ্চিম পাশে নদীর চরে নিয়ে গিয়ে গুলি করে। ঘটনাস্থলে ৫ জন মারা যান। মুমূর্ষু অবস্থায় আবদুর রহিম ও আবদুল গাজী কোনোরকমে নদীতে ভাসতে ভাসতে চিংড়া গ্রামে পৌঁছান। পরের দিনই এই খবর রাজাকার বাহিনীর কাছে পৌঁছে যায়। ২১ সেপ্টেম্বর রাজাকাররা আবদুর রহিমকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করে। অপর আহত আবদুল গাজী বিনা চিকিৎসায় ধুঁকতে ধুঁকতে মারা যান।

চিংড়া গণহত্যায় নিহত ৭ জন হলেন: মোহর আলী ফকির (পিতা: শরীফুল্লাহ, চিংড়া), আবদুর রহিম জোদ্দার (পিতা: আমীর আলী জোদ্দার, চিংড়া), আবদুল গফুর জোদ্দার (পিতা: আমীর আলী জোদ্দার, চিংড়া), সফেদ আলী সরদার (পিতা: ছপো সরদার, চিংড়া), আবদুল গাজী (পিতা: জমাদ্দার গাজী, চিংড়া), জফর আলী শেখ (পিতা: হাজের আলী শেখ, চিংড়া) এবং হারান ঋষি (পিতা: নিরাপদ ঋষি, শিবপুর, শোভনা)।

সূত্র

- বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড

- একাত্তরে খুলনা মানবিক বিপর্যয়ের ইতিহাস - দিব্যদ্যুতি সরকার (সাক্ষাৎকার: রমেন্দ্রনাথ চ্যাটার্জী, ১৫ এপ্রিল ২০১৫; শেখ আমজাদ হোসেন, ৩০ এপ্রিল ২০১৫)

অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

৪ অক্টোবর ১৯৭১: বিনা শর্তে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবি মধ্যপ্রদেশের বিধানসভায়

১ অক্টোবর ১৯৭১: রায়পুরের রাজাকার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গেরিলাদের আক্রমণ

হাসনাবাদ গণহত্যা (নবাবগঞ্জ, ঢাকা)

কাটেঙ্গা গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: ‘পূর্ব বাংলার সমস্যার সমাধান শেখ মুজিবের সঙ্গেই করতে হবে’

২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: “বিদেশি চাপে আমাদের বহু চেষ্টা নস্যাত হয়ে গেছে”

২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: জাতিসংঘে বাংলাদেশ নিয়ে নাটকীয়তা

সাদকপুর গণহত্যা (বুড়িচং, কুমিল্লা)

ফুলদহেরপাড়া গণহত্যা (সরিষাবাড়ী, জামালপুর)

আন্দুলিয়া গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

১০

২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বিজয়ই আমাদের একমাত্র ও চূড়ান্ত গন্তব্য

১১

জুলাই অভ্যুত্থানের প্রতারণা: জনগণের অট্টহাসি ও অবিশ্বাসের প্রতিফলন

১২

২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: চালনা বন্দরে মার্কিন জাহাজ মাইন বিস্ফোরণে ধ্বংস

১৩

বীর উত্তম আবদুস সালেক চৌধুরী: আকাশছোঁয়া হয়ে উঠেছিল যাঁর সাহস

১৪

রামনগর গণহত্যা (রায়পুরা, নরসিংদী)

১৫

২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে ভিয়েতনামের সমর্থন

১৬

মামুদপুর গণহত্যা (গোপালপুর, টাঙ্গাইল)

১৭

ত্রিমোহনী গণহত্যা ও বধ্যভূমি, নেত্রকোনা

১৮

২২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: ঢাকায় প্রাদেশিক মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠক

১৯

চিংড়া গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

২০