ঢাকা মঙ্গলবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৫, ২৯ আশ্বিন ১৪৩২
মুক্ত মনমুক্ত চিন্তামুক্তি গাথা

২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: জাতিসংঘে বাংলাদেশ নিয়ে নাটকীয়তা

প্রিয়ভূমি প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০১:০৪ এএম
ছবি: আনন্দবাজার

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ২৭ সেপ্টেম্বর একটি গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল দিন। এই দিনটিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ফ্রন্টে মুক্তিবাহিনীর সাহসী অভিযান এবং আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক ঘটনা উল্লেখযোগ্য ছিল।

মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধক্ষেত্রের ঘটনা

মুক্তিবাহিনীর গেরিলা দল মাগুরা বাজার থেকে রসদ নিয়ে দেহার থানার ক্যাম্পে যাওয়ার পথে পাকসেনাদের একটি দলকে আক্রমণ করে। এতে ১৪ জন পাকসেনা নিহত এবং ৮ জন আহত হয়। গেরিলা যোদ্ধারা পাকসেনাদের সমস্ত রসদ দখল করে নেয়।

৪ নম্বর সেক্টরে মুক্তিবাহিনী পাকসেনাদের একটি দলকে রসদ নিয়ে বড়াইল ক্যাম্পের দিকে যাওয়ার পথে অ্যামবুশ করে। এই অ্যামবুশে ২ জন পাকসেনা নিহত হয়। মুক্তিবাহিনী মর্টারের সাহায্যে নওয়াবগঞ্জ থানায় পাকসেনাদের রামচন্দ্রপুর ঘাঁটিতে আক্রমণ চালায়। এতে পাকবাহিনীর ৭ জন সেনা নিহত হয়।

৬ নম্বর সেক্টরে মুক্তিবাহিনী কমান্ডার মোত্তালিব এবং কমান্ডার এস.এম. ফারুকের নেতৃত্বে হিলিতে পাকসেনাদের সঙ্গে প্রচণ্ড যুদ্ধে লিপ্ত হয়। আড়াই ঘণ্টাব্যাপী এই যুদ্ধে ৪ জন পাকসেনা নিহত হয়। অপরদিকে, মুক্তিবাহিনীর বীর যোদ্ধা কমান্ডার মোত্তালিব মর্টারের গুলিতে আহত হন।

মুক্তিবাহিনী ময়মনসিংহের গফরগাঁও এলাকায় পাকসেনাদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এই সংঘর্ষে পাকবাহিনীর ২ জন সৈন্য নিহত হয়। পাকবাহিনী ৪টি লঞ্চে করে নওয়াবগঞ্জের দিকে অগ্রসর হলে ৫০ জন গেরিলার নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী মুক্তিযোদ্ধা দল গোলিমপুরের কাছে লঞ্চগুলোকে আক্রমণ করে। এই আক্রমণে পাকবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেনসহ ৩৫ জন সৈন্য নিহত এবং অনেকে আহত হয়। বাকি পাকসেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ দখল করে।

খুলনার সাতক্ষীরার কালিগঞ্জে বেশ কিছু এলাকা মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে। মুক্তিবাহিনী শত্রুসেনার অবস্থান লক্ষ্য করে প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ করলে ২০ জন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার নিহত এবং ১৫ জন গুরুতর আহত হয়। মুক্তিবাহিনী মুক্ত এলাকার বিভিন্ন স্থানে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে।

২ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা কায়েমপুর পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাঁটি আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধাদের চাপের মুখে টিকতে না পেরে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা ঘাঁটি থেকে পশ্চাদপসরণ করে। যুদ্ধে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে কয়েকজন বীর যোদ্ধা শহীদ ও আহত হন। মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাঁটি থেকে মেশিনগান, মর্টারসহ বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ হস্তগত করে।

একই সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি দল ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কসবার কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর অন্য একটি ঘাঁটিতে মর্টার হামলা চালায়। সংঘর্ষে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয় এবং একজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হয়।

আন্তর্জাতিক ও কূটনৈতিক ঘটনা

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশ সমস্যা নিয়ে আলোচনার জন্য তিন দিনের সরকারি সফরে মস্কো রওনা হন এবং সেখানে পৌঁছেন। ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে তিনি সোভিয়েত নেতাদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করবেন। নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশনে বাংলাদেশসংক্রান্ত বিতর্কে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং বক্তব্য দেওয়ার সময় পাকিস্তানের প্রতিনিধি আগা শাহি বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে নাটকীয়তা সৃষ্টি হয়। আগা শাহি বৈধতার প্রশ্ন তুলে বলেন, এর মাধ্যমে ভারত পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করছে। তবে আগা শাহির বাধা দেওয়ার চেষ্টা ব্যর্থ হয়। সাধারণ পরিষদের সভাপতি ইন্দোনেশিয়ার ড. আদম মালিক সরদার শরণ সিংয়ের বক্তব্যের সময় চুপ থাকেন এবং তা বিধিবহির্ভূত বলেননি।

সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূত বারুদি আগা শাহির পক্ষ নিয়ে প্রস্তাব করেন যে, শরণ সিংয়ের বক্তৃতার পুস্তিকা সদস্যদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে, এবং আপত্তিকর অংশগুলো বাদ দেওয়া উচিত।

সরদার শরণ সিং সব বাধা উপেক্ষা করে বাংলাদেশের পরিস্থিতির পটভূমি এবং তার ফলে ৯০ লাখ শরণার্থীর ভারতে আশ্রয় নেওয়ায় উদ্ভূত জটিল অবস্থার জোরালো বিবরণ দেন। তিনি সদস্যরাষ্ট্রগুলোকে সতর্ক করে বলেন, ইসলামাবাদের সামরিক শাসকদের বুঝিয়ে বলা উচিত যে নির্যাতন চালিয়ে সফল হওয়া যাবে না; রাজনৈতিক সমাধান অত্যাবশ্যক। এই সমস্যা সমাধানের জন্য তিনি অবিলম্বে শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেওয়ার দাবি জানান।

সরদার শরণ সিং আরও বলেন, পাকিস্তানের সামরিক চক্র বাংলাদেশে গণহত্যা চালিয়ে জাতিসংঘের সনদ লঙ্ঘন করেছে, তাই এটি আর পাকিস্তানের ঘরোয়া ব্যাপার নয়। যে দল পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সরকার গঠন করত, তারাই আজ সামরিক আদেশে নিষিদ্ধ।

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে পাকিস্তানি প্রতিনিধিদলের নেতা মাহমুদ আলী বলেন, তাঁর সরকার ভারত সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসতে এবং নিরাপত্তা পরিষদের মধ্যস্থতা মেনে নিতে রাজি। তবে ভারতের বিপজ্জনক নীতির জন্য পরিষদের উচিত ভারতকে সতর্ক করে দেওয়া।

মওলানা এম. এম. মান্নানের নেতৃত্বে মাদ্রাসা শিক্ষক সমিতির একটি প্রতিনিধি দল ‘খ’ অঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসক লে. জেনারেল নিয়াজীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। সাক্ষাতে মওলানা মান্নান বলেন, পাকিস্তানি নিরাপত্তার জন্য মাদ্রাসার শিক্ষকরা লে. জেনারেল নিয়াজীকে পূর্ণ সহযোগিতা করবেন। তিনি লে. জেনারেল নিয়াজীকে একখানা কোরআন শরিফ উপহার দিয়ে আশ্বাস দেন যে, ওলেমা ও মাদ্রাসা শিক্ষকরা রাষ্ট্রবিরোধীদের উৎখাতে সেনাবাহিনীকে সাহায্য করতে প্রস্তুত।

পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসকের দপ্তর থেকে জারি করা এক বিজ্ঞপ্তিতে জনগণকে সতর্ক করে বলা হয় যে, কোনোক্রমেই নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করা যাবে না।

সূত্র

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: দলিলপত্র, দশম খণ্ড;

দৈনিক পাকিস্তান, ঢাকা, ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭১;

আনন্দবাজার পত্রিকা ও যুগান্তর, কলকাতা, ভারত, ২৮ ও ২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১।

অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

৪ অক্টোবর ১৯৭১: বিনা শর্তে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবি মধ্যপ্রদেশের বিধানসভায়

১ অক্টোবর ১৯৭১: রায়পুরের রাজাকার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গেরিলাদের আক্রমণ

হাসনাবাদ গণহত্যা (নবাবগঞ্জ, ঢাকা)

কাটেঙ্গা গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: ‘পূর্ব বাংলার সমস্যার সমাধান শেখ মুজিবের সঙ্গেই করতে হবে’

২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: “বিদেশি চাপে আমাদের বহু চেষ্টা নস্যাত হয়ে গেছে”

২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: জাতিসংঘে বাংলাদেশ নিয়ে নাটকীয়তা

সাদকপুর গণহত্যা (বুড়িচং, কুমিল্লা)

ফুলদহেরপাড়া গণহত্যা (সরিষাবাড়ী, জামালপুর)

আন্দুলিয়া গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

১০

২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বিজয়ই আমাদের একমাত্র ও চূড়ান্ত গন্তব্য

১১

জুলাই অভ্যুত্থানের প্রতারণা: জনগণের অট্টহাসি ও অবিশ্বাসের প্রতিফলন

১২

২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: চালনা বন্দরে মার্কিন জাহাজ মাইন বিস্ফোরণে ধ্বংস

১৩

বীর উত্তম আবদুস সালেক চৌধুরী: আকাশছোঁয়া হয়ে উঠেছিল যাঁর সাহস

১৪

রামনগর গণহত্যা (রায়পুরা, নরসিংদী)

১৫

২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে ভিয়েতনামের সমর্থন

১৬

মামুদপুর গণহত্যা (গোপালপুর, টাঙ্গাইল)

১৭

ত্রিমোহনী গণহত্যা ও বধ্যভূমি, নেত্রকোনা

১৮

২২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: ঢাকায় প্রাদেশিক মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠক

১৯

চিংড়া গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

২০