বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ (১৯৭১) ইতিহাসে কয়েকজন নাম এমন যে, তাদের সাহস, নেতৃত্ব ও বলিদানের কথা শুনলে রোমাঞ্চ হয়ে ওঠে। এর মধ্যে বীর উত্তম আবদুস সালেক চৌধুরীর নাম এক অনন্য স্থান দখল করে আছে। মাত্র ২৫ বছর বয়সে তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর চতুর্থ বৃহত্তম আধুনিক সেনাবাহিনীর মুখোমুখি হয়ে লড়াই করেছিলেন, একটি সাব-সেক্টরের কমান্ডার হয়ে উঠেছিলেন, একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যাটেলিয়ন গড়ে তুলেছিলেন এবং শেষপর্যন্ত 'কে' ফোর্সের কমান্ডার হিসেবে তিনটি ব্রিগেডের অন্যতম ব্রিগেডের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এত কম বয়সে এমন দুর্ধর্ষ নেতৃত্বের উদাহরণ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে দ্বিতীয়টি নেই। তাঁর জন্মদিন ২০ সেপ্টেম্বর, এবং তাঁর সাহসিকতার স্বীকৃতিতে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে বীর উত্তম খেতাব প্রদান করেছিল (সনদ নম্বর ১২)। তাঁর জীবনী শুধু যুদ্ধের গল্প নয়, এটি একটি পরিবারের সম্পূর্ণ নিবেদনের আখ্যান। এই প্রতিবেদনে আমরা তাঁর জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে গবেষণামূলক আলোচনা করব, যা বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে সংগ্রহিত।
প্রারম্ভিক জীবন ও শিক্ষা
আবদুস সালেক চৌধুরী জন্মগ্রহণ করেন ২০ সেপ্টেম্বর ১৯৪৬ সালে ঢাকা জেলার দোহার উপজেলার হাতুরপাড়া গ্রামে। তাঁর পিতার নাম ছিল আবদুল রহিম চৌধুরী (কিছু উৎসে এ. আর. চৌধুরী বলা হয়েছে), এবং মাতার নাম সায়মা খানম (অন্যান্য উৎসে সায়মা খাতুন)। তাঁর পরিবার ছিল মধ্যবিত্ত, এবং তিনি আট ভাইবোনের মধ্যে চতুর্থ স্থানে ছিলেন। এই পরিবারটি পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধে সম্পূর্ণভাবে নিবেদিত হয়ে ওঠে, যা তাঁর জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পটভূমি।
শিক্ষাজীবনে তাঁর মেধা ছিল অসাধারণ। তিনি সেন্ট গ্রেগরি স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন এবং বোর্ডে স্থান অর্জন করেন। পরে ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট সম্পন্ন করেন, যেখানেও তিনি বোর্ডে স্থান পান। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে প্রথম বর্ষে ভর্তি হন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবনের মাঝামাঝি সময়ে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন, যা তাঁর জীবনের একটি টার্নিং পয়েন্ট। তাঁর শিক্ষাগত সাফল্য তাঁকে সামরিক একাডেমিতে সেরা করে তোলে, যা পরে তাঁর নেতৃত্বের ভিত্তি গড়ে।
সামরিক কর্মজীবনের শুরু
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবনের সময় পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি (পিএমএ), কাকুলে (পশ্চিম পাকিস্তান) যোগ দেন আবদুস সালেক চৌধুরী। ১৯৬৬ সালে তিনি কমিশন লাভ করেন এবং ২৫তম ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টে যোগ দেন। পিএমএ-তে তাঁর অসাধারণ সাফল্যের জন্য তিনি 'সোর্ড অব অনার' (পুরো ব্যাচে প্রথম স্থান) পুরস্কার লাভ করেন, যা তাঁর দুর্ধর্ষতার প্রথম স্বীকৃতি। ১৯৭১ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত তিনি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে কর্মরত ছিলেন এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। কিন্তু ২৫ মার্চের নৃশংস গণহত্যার পর তাঁর মনে দেশপ্রেমের জোয়ার উথলে ওঠে।
মুক্তিযুদ্ধে যোগদান ও নেতৃত্ব
১৯৭১ সালের ২২ এপ্রিল মধ্যরাতে তিনি ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালিয়ে ভারতে চলে যান এবং মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন। প্রথমদিকে তিনি কুমিল্লা অঞ্চলে বীর উত্তম খালেদ মোশাররফের অধীনে যুদ্ধ করেন। সেক্টর গঠনের পর তিনি ২ নম্বর সেক্টরের সালদা নদী সাব-সেক্টরের কমান্ডার নিযুক্ত হন। এই সাব-সেক্টরটি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ রণাঙ্গন হিসেবে পরিচিত, কারণ এটি সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থিত এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইনের মধ্য দিয়ে গেছে, যা পাকিস্তানিদের লাইফলাইন ছিল।
জুলাই মাসে তিনি মেজরে প্রমোশন পান। মুক্তিযুদ্ধের সেপ্টেম্বর মাসে ২ নম্বর সেক্টর পুনর্গঠিত হলে, চতুর্থ বেঙ্গলের এ-কোম্পানি ও বি-কোম্পানির অবশিষ্ট সেনাদের নিয়ে তিনি ১০ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট গঠন করেন এবং প্রতিষ্ঠাতা কমান্ডার হন (পরে দায়িত্ব তুলে দেন ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের কাছে)। অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে কসবা অপারেশনে খালেদ মোশাররফ গুরুতর আহত হলে, তিনি 'কে' ফোর্সের কমান্ডার হন। এই ফোর্সে ছিল চতুর্থ, নবম ও দশম বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং মুজিব ব্যাটারি। সাধারণত ব্রিগেডের অধিনায়ক হন জেনারেল, কিন্তু ২৫ বছর বয়সী এই সদ্য প্রমোশনপ্রাপ্ত মেজর একটি ব্রিগেডের প্রধান হয়ে ওঠেন—এটি ছিল অবিশ্বাস্য।
নির্দিষ্ট যুদ্ধকার্যাবলী
সালদা নদী সাব-সেক্টর ছিল পাকিস্তানিদের জন্য চ্যালেঞ্জিং। প্রাথমিক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা ব্যাপক হতাহতের শিকার হতেন, কিন্তু আবদুস সালেকের নেতৃত্বে পরিস্থিতি বদলে যায়।
তাঁর নেতৃত্বে সালদা এলাকা একটি জনপদে পরিণত হয়, যা মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানি উভয়ের জন্য চ্যালেঞ্জিং ছিল।
গ্রানাডা টেলিভিশনের ইন্টারভিউ: বিশ্বের সামনে সাহসের প্রদর্শন
মুক্তিযুদ্ধের জুন মাসে গ্রানাডা টিভির 'ওয়ার্ল্ড ইন অ্যাকশন' প্রোগ্রামে 'মেজর খালেদস ওয়ার' নামে একটি ডকুমেন্টারি নির্মিত হয়, যা বিশ্বজুড়ে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করে। এতে আবদুস সালেকের ইন্টারভিউ প্রধান আকর্ষণ। পরিচালক ভানিয়া সারাহ কিউলির প্রশ্নে তিনি বলেন, "দেখো, অন্য সেক্টরে যেমন যুদ্ধ চলে, আমার সেক্টরেও তেমনই যুদ্ধ চলছে।... গতকাল তো তুমি দেখেছো আমরা কীভাবে এতো অস্ত্র নিয়ে সম্মুখযুদ্ধ করছি। তাহলে কীভাবে এটাকে সীমান্তের সংঘর্ষ বলতে পারো?" তিনি পাকিস্তানি প্রোপাগান্ডা খণ্ডন করে বিশ্বকে জানান যে এটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ। পরিবারের প্রশ্নে তিনি বলেন, "আমার পরিবারের সঙ্গে কী ঘটেছে আমি জানি না।... আমার একটাই দায়িত্ব, যে কোন মূল্যে জন্মভূমিকে শত্রুমুক্ত করতে হবে।" সুদানের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, "তাঁরা অস্ত্র ছাড়াই যুদ্ধ করছে, তাহলে আমরা কেন পারব না?" এই ইন্টারভিউ তাঁর দুর্ধর্ষতার প্রমাণ।
পরিবারের অবদান: এক পরিবারের সম্পূর্ণ বলিদান
আবদুস সালেকের পরিবার মুক্তিযুদ্ধে সম্পূর্ণ নিবেদিত ছিল। তাঁর তিন ভাই সরাসরি রণাঙ্গনে অংশ নেন:
আবদুল খালেক চৌধুরী: আলবদর বাহিনী তুলে নিয়ে হত্যা করে। আবদুল মালেক চৌধুরী: রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনারা আটক করে টর্চার সেলে নির্যাতন করে, কিন্তু ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যান। আবদুল মতিন চৌধুরী: রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেন। আবদুল মজিদ চৌধুরী: প্রবাসে থেকে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করেন। তাঁর বড় ভাই আবদুল মালেকের নির্যাতনের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেছিলেন, "আমি অন্য অফিসারদের পরিবারের দুর্ভাগ্য দেখেছি, তাই আমি পালিয়ে এসেছি।" এই পরিবারের বলিদান অবর্ণনীয়।
মৃত্যু: রহস্যময় প্রস্ঙ্গ
দুঃখের বিষয়, মুক্তিযুদ্ধের এক বছরের মাথায়, ১৯৭২ সালের ১৯ নভেম্বর যশোরে আবদুস সালেক চৌধুরী মারা যান, তখন তাঁর বয়স মাত্র ২৬। সেনাবাহিনীর দাবি, তিনি নিজের পিস্তল মাথায় ঠেকিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। কিন্তু এটি বিতর্কিত। কেউ বলেন তাঁকে হত্যা করা হয়েছে, কেউ বলেন রোড অ্যাক্সিডেন্ট বা সামরিক অপারেশনে নিহত। প্রকৃত কারণ অজানাই রয়ে গেছে, যা তাঁর জীবনকে আরও রহস্যময় করে তোলে। তিনি অবিবাহিত ছিলেন।
ঐতিহ্য ও স্মৃতি
আবদুস সালেক চৌধুরীর ঐতিহ্য অমর। ২০১০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি তাজুল মোহাম্মদের লেখা 'মেজর আবদুস সালেক চৌধুরী বীর উত্তম ও সালদা যুদ্ধ' বই প্রকাশিত হয়, যা তাঁর জীবন ও সালদা যুদ্ধের বিস্তারিত বর্ণনা দেয়। গ্রানাডা ডকুমেন্টারিটি এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁর ইন্টারভিউ এখনও ভাইরাল হয়। বাংলাদেশের যুবসমাজের মধ্যে তাঁর গল্প অনুপ্রেরণার উৎস। তাঁর জন্মদিনে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে স্মরণ করা হয়।
আবদুস সালেক চৌধুরী ছিলেন সেই যোদ্ধা, যাঁর সাহস মাত্র ২৫ বছর বয়সে আকাশছোঁয়া হয়ে উঠেছিল। তাঁর নেতৃত্বে সালদা নদী একটি কিংবদন্তি হয়ে ওঠে, এবং তাঁর কথা আজও বলে যে, দেশের জন্য যুদ্ধ করতে হলে পরিবার ছেড়ে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে হয়। তাঁর মৃত্যুর রহস্য থাকলেও, তাঁর অবদান চিরকাল জাগরূক। বাংলাদেশের স্বাধীনতার এই বীরকে স্মরণ করে আমরা শুধু গৌরবান্বিত হই না, অনুপ্রাণিতও হই। জয় বাংলা!
মন্তব্য করুন