ঢাকা মঙ্গলবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৫, ২৯ আশ্বিন ১৪৩২
মুক্ত মনমুক্ত চিন্তামুক্তি গাথা

২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: চালনা বন্দরে মার্কিন জাহাজ মাইন বিস্ফোরণে ধ্বংস

প্রিয়ভূমি প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৩:২৯ পিএম
ছবি: অমিও চক্রবর্তী

১৯৭১ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল দিন। এই দিনে দেশে-বিদেশে বিভিন্ন ঘটনা ঘটেছিল, যা মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে উল্লেখযোগ্য। নিম্নে সেদিনের প্রধান ঘটনাগুলো সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো।

আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের শরণার্থী সমস্যা

এই দিনে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং। তিনি মহাসচিবকে বলেন,

বাংলাদেশের শরণার্থী সমস্যার সমাধান ভারত একা করতে পারে না। এই সমস্যা সমাধানে সকলেরই এগিয়ে আসা উচিত এবং হস্তক্ষেপ করা প্রয়োজন। শরণার্থী সমস্যা কেবল ভারতের দায়িত্ব নয়। পাকিস্তান নিজেই এই সমস্যার মূল কারণ। তারা নিজেদের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে এই সংকট সৃষ্টি করেছে। মানুষ প্রাণ বাঁচাতে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে।

তিনি আরও বলেন,

যতক্ষণ পর্যন্ত পাকিস্তানের ওপর চাপ প্রয়োগ করে রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক না করা হবে, ততক্ষণ এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। পাকিস্তান এই সমাধান চায় না, নইলে তারা বারবার ভারতের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ ও অপপ্রচার চালাত না।

জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে এই দিনে সদস্য মাওলানা এ টি সাদী বলেন,

বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের কারণে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ অনিবার্য ছিল। দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনতে সেনাবাহিনী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে। বাংলাদেশ আন্দোলন ইসলামের বিরুদ্ধে একটি ষড়যন্ত্র।

ঢাকার ঘটনাপ্রবাহ

ঢাকায় এই দিনে পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির (পিডিপি) সভাপতি নুরুল আমিন বলেন,

বেআইনি ঘোষিত আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিলে পূর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর কার্যক্রমের যৌক্তিকতা নষ্ট হয়ে যাবে।

একই দিনে পূর্ব পাকিস্তানের একজন সরকারি মুখপাত্র জানান,

গঙ্গা ব-দ্বীপের চালনা বন্দরে একটি মার্কিন জাহাজ মাইন বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়েছে। জাহাজটি পূর্ব পাকিস্তানে খাদ্যসামগ্রী নিয়ে এসেছিল। সম্প্রতি একটি ব্রিটিশ জাহাজও একইভাবে চালনা বন্দরে বোমা বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়। এই ঘটনাগুলো বাংলাদেশের পরিস্থিতির গুরুত্ব তুলে ধরে।

এদিন ঢাকার তেজগাঁও শান্তি কমিটি নবনিযুক্ত মন্ত্রীদের সংবর্ধনা দেয়। জামায়াতে ইসলামীর ডেপুটি আমির মাওলানা আবদুর রহিমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সভায় আব্বাস আলী খান, মাওলানা এ কে এম ইউসুফ, আখতারউদ্দিন আহমদ, মাওলানা ইসহাক, অং শৈ প্রু চৌধুরী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। সভায় তেজগাঁও শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান মন্ত্রীদের উদ্দেশে মানপত্র পাঠ করেন।

একই দিনে পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমির গোলাম আযম একটি বৈঠক আহ্বান করেন। এই বৈঠক ২ অক্টোবর নাখালপাড়ায় জামায়াতের প্রাদেশিক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হবে। বৈঠকে দেশের বর্তমান পরিস্থিতি, উপনির্বাচন এবং পার্টি-কর্মীদের করণীয় নিয়ে আলোচনা হবে বলে জানানো হয়।

দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ

১. নবীনগর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া: এই দিনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি শক্তিশালী দল ১৭টি নৌকায় করে নবীনগরের দিকে অগ্রসর হওয়ার সময় বিদ্যাকোর্ট গ্রামের কাছে মুক্তিবাহিনীর একটি দল তাদের নৌকাগুলোর ওপর আক্রমণ চালায়। এতে পাকিস্তানি বাহিনীর পাঁচটি নৌকা ডুবে যায়, ২৫ জন সৈন্য নিহত এবং ৩৫ জন আহত হয়।

২. শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার: মুক্তিযোদ্ধারা সিন্দরখান-কালেঙ্গা রাস্তার পাহাড়ের ফাঁকে বাঙ্কার খনন করে হানাদার বাহিনীর জন্য অপেক্ষা করছিলেন। দুপুরে হানাদার বাহিনীর একটি দল ২০-২৫ জন রাজাকারকে সামনে রেখে কালেঙ্গার দিকে অগ্রসর হলে মুক্তিবাহিনী অ্যামবুশ করে। আকস্মিক আক্রমণে হানাদার বাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়ে এবং ঘটনাস্থলে বহু সৈন্য নিহত হয়। পরে তারা পালিয়ে যায়। এই যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর একজন অফিসারসহ ৬১ জন সৈন্য নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়। মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মান্নান এই যুদ্ধে শহীদ হন।

৩. ধর্মঘর, ৩ নম্বর সেক্টর: মুক্তিবাহিনীর ক্যাপ্টেন ভুঁইয়ার নেতৃত্বে একটি দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায়। হানাদার বাহিনী তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুললেও লেফটেন্যান্ট হেলাল মুর্শেদ ও ক্যাপ্টেন নাসিমের কোম্পানি ফ্ল্যাঙ্ক প্রোটেকশনের মাধ্যমে সহায়তা করে। শেষ পর্যন্ত হানাদার বাহিনী পিছু হটে। এই যুদ্ধে ১০ জন হানাদার সৈন্য নিহত হয়।

৪. খড়মপুর, ৪ নম্বর সেক্টর: মুক্তিবাহিনীর ৬০ জনের একটি দল খড়মপুরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ৪০ জনের একটি দলের ওপর আক্রমণ চালায়। হানাদার বাহিনী তিন ইঞ্চি মর্টার, এমজি ও এলএমজি ব্যবহার করে পাল্টা আক্রমণ করে। তীব্র সংঘর্ষে পাঁচজন হানাদার সৈন্য নিহত এবং ১০ জন আহত হয়।

৫. ৮ নম্বর সেক্টর: মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি প্লাটুনকে অ্যামবুশ করে। এই অ্যামবুশে চারজন হানাদার সৈন্য নিহত এবং দুজন আহত হয়। একই দিনে বিকেলে মুক্তিযোদ্ধারা একই স্থানে আরেকটি প্লাটুনকে অ্যামবুশ করে, যাতে আরও চারজন হানাদার সৈন্য নিহত হয়।

সূত্র

  • বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র সপ্তম, দশম ও ত্রয়োদশ খণ্ড।

  • দৈনিক পাকিস্তান, ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১।

  • দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা, ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১।

অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

৪ অক্টোবর ১৯৭১: বিনা শর্তে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবি মধ্যপ্রদেশের বিধানসভায়

১ অক্টোবর ১৯৭১: রায়পুরের রাজাকার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গেরিলাদের আক্রমণ

হাসনাবাদ গণহত্যা (নবাবগঞ্জ, ঢাকা)

কাটেঙ্গা গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: ‘পূর্ব বাংলার সমস্যার সমাধান শেখ মুজিবের সঙ্গেই করতে হবে’

২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: “বিদেশি চাপে আমাদের বহু চেষ্টা নস্যাত হয়ে গেছে”

২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: জাতিসংঘে বাংলাদেশ নিয়ে নাটকীয়তা

সাদকপুর গণহত্যা (বুড়িচং, কুমিল্লা)

ফুলদহেরপাড়া গণহত্যা (সরিষাবাড়ী, জামালপুর)

আন্দুলিয়া গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

১০

২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বিজয়ই আমাদের একমাত্র ও চূড়ান্ত গন্তব্য

১১

জুলাই অভ্যুত্থানের প্রতারণা: জনগণের অট্টহাসি ও অবিশ্বাসের প্রতিফলন

১২

২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: চালনা বন্দরে মার্কিন জাহাজ মাইন বিস্ফোরণে ধ্বংস

১৩

বীর উত্তম আবদুস সালেক চৌধুরী: আকাশছোঁয়া হয়ে উঠেছিল যাঁর সাহস

১৪

রামনগর গণহত্যা (রায়পুরা, নরসিংদী)

১৫

২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে ভিয়েতনামের সমর্থন

১৬

মামুদপুর গণহত্যা (গোপালপুর, টাঙ্গাইল)

১৭

ত্রিমোহনী গণহত্যা ও বধ্যভূমি, নেত্রকোনা

১৮

২২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: ঢাকায় প্রাদেশিক মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠক

১৯

চিংড়া গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

২০