বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ১৯৭১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর একটি কালো দিন হিসেবে চিহ্নিত, যখন কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম উপজেলার ইকরদিয়া গ্রামে এক ভয়াবহ গণহত্যা সংঘটিত হয়। এই ঘটনায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাথে স্থানীয় রাজাকার এবং আলবদর বাহিনীর সদস্যরা যুক্ত হয়ে নির্মমতার চরম সীমা অতিক্রম করে। ফলে ৩৫ জন নিরীহ মানুষ শহীদ হন, যাদের অধিকাংশ ছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্য। এই গণহত্যা শুধু একটি গ্রামের ট্র্যাজেডি নয়, বরং মুক্তিযুদ্ধের সময়কার সংখ্যালঘু নির্যাতনের একটি প্রতীকী উদাহরণ, যা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দমনমূলক কৌশল এবং স্থানীয় দালালদের ভূমিকাকে উন্মোচিত করে। এই ঘটনার পটভূমি, ঘটনাপ্রবাহ, পরিণতি এবং শহীদদের স্মৃতি বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো, যাতে এই নির্মমতার স্মৃতি জীবন্ত থাকে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য শিক্ষা হয়ে ওঠে।
গণহত্যার পটভূমি: অষ্টগ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীর আগমন এবং নির্যাতনের শুরু
মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে অষ্টগ্রাম অঞ্চলটি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জন্য একটি কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিল, যেখানে তারা তাদের দমনমূলক অভিযান চালিয়ে যাচ্ছিল। ১৯৭১ সালের ২৮ আগস্ট পাকহানাদার বাহিনী অষ্টগ্রামে প্রবেশ করে এবং সেখানে দীর্ঘ সময় অবস্থান করে। বিশেষ করে, ২৮ আগস্ট থেকে ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত এই অঞ্চলে তাদের উপস্থিতি ছিল অব্যাহত। এই সময়কালে পাকসেনারা স্থানীয় মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের সাথে যুক্ত হয়ে শান্তি কমিটি, রাজাকার এবং আলবদর বাহিনীর মাধ্যমে লুটতরাজ, নির্যাতন এবং হত্যাকাণ্ডের একটি ধারাবাহিকতা শুরু করে। এই বাহিনীগুলোর লক্ষ্য ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের দমন করা, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে ভীতি প্রদর্শন করা এবং স্থানীয় জনগণের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করা। অষ্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় তারা নির্যাতন চালায়, যা গ্রামীণ জীবনকে বিপর্যস্ত করে তোলে।
ইকরদিয়া গ্রামটি এই অঞ্চলের একটি ছোট্ট গ্রাম, যেখানে শতভাগ অধিবাসী ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত। এই গ্রামের মানুষের জীবিকা মূলত মৎস্য শিকারের উপর নির্ভরশীল ছিল, যা তাদেরকে নদী-নির্ভর একটি সাধারণ জীবনযাত্রা প্রদান করত। সংখ্যালঘু হওয়ার কারণে এই গ্রামটি স্থানীয় দালাল এবং পাকসেনাদের শ্যেন দৃষ্টিতে পড়ে। পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের সহযোগীদের লক্ষ্য ছিল এমন গ্রামগুলোকে নিশানা করা, যেখানে হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘনত্ব বেশি, কারণ এটি তাদের ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক বিদ্বেষের অংশ ছিল। এই পটভূমিতে ৩ সেপ্টেম্বরের গণহত্যা ঘটে, যা অষ্টগ্রামের নির্যাতনের একটি চরম উদাহরণ।
গণহত্যার ঘটনাপ্রবাহ: নির্মম আক্রমণ এবং প্রাণহানি
১৯৭১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর সকালে, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী স্থানীয় রাজাকার এবং আলবদর সদস্যদের সহযোগিতায় ইকরদিয়া গ্রামে প্রবেশ করে। এই আক্রমণটি ছিল পরিকল্পিত এবং দ্রুতগতির। হানাদারদের আগমনের খবর মুহূর্তের মধ্যে সমগ্র গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে, যার ফলে গ্রামের মানুষ প্রাণভয়ে যে যেদিকে পারে পালাতে শুরু করে। যারা দ্রুত পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়, তারা প্রাণে রক্ষা পায়। কিন্তু যারা পালাতে পারেনি—বিশেষ করে নারী, শিশু, বৃদ্ধ এবং যুবকরা—তারা নির্মম গণহত্যার শিকার হয়। পাকবাহিনী এবং তাদের দোসররা নির্বিচারে হত্যা করে, যাতে নারী, শিশু, বৃদ্ধ এবং যুবক সবাই অন্তর্ভুক্ত ছিল। মোট ৩৫ জনকে হত্যা করা হয়, এবং এই হত্যাকাণ্ডের প্রধান স্থান ছিল গ্রামের হরিচরণের বাড়ির মঠের নিচে চণ্ডীতলায়। ঘাতকরা এখানে সবার প্রাণ সংহার করে, যা একটি লোমহর্ষক দৃশ্য তৈরি করে।
এই গণহত্যা শুধু শারীরিক নির্যাতন নয়, বরং একটি মানসিক যুদ্ধের অংশ ছিল। গ্রামের মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের নিয়ন্ত্রণ শক্তিশালী করতে চেয়েছিল। কিন্তু এই ঘটনা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধকে আরও তীব্র করে তোলে, যা শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতার পথ প্রশস্ত করে।
গণহত্যার পরিণতি: মৃতদেহের ভয়াবহ অবস্থা এবং স্থানীয় প্রভাব
গণহত্যার পর নিহতদের অধিকাংশের মৃতদেহ নদীর পানিতে ভেসে যায়, যা গ্রামের নদী-নির্ভর জীবনের সাথে যুক্ত। বাকি মৃতদেহগুলো চণ্ডীতলা মঠের কাছে কুকুর এবং শুকুনের খাবারে পরিণত হয়। তাদের হাড় এবং মাথার খুলি অনেক দিন ধরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে ছিল, যা এই ঘটনার ভয়াবহতাকে চিরস্থায়ী করে রেখেছে। এই দৃশ্যগুলো গ্রামের বাসিন্দাদের মনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে, এবং অনেক স্বজন বুকভরা কষ্ট নিয়ে পিতৃভূমি ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়। ফলে নিহতদের কয়েকজনের নাম বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যায়, যা একটি দুঃখজনক বাস্তবতা।
যারা বেঁচে আছেন, তারা এখনও সেই লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ডের কথা ভারাক্রান্ত হৃদয়ে স্মরণ করেন। ইকরদিয়ার শহীদদের আত্মত্যাগ গৌরবোজ্জ্বল মহিমায় এই জনপদে স্মরণ করা হয়। গভীর শ্রদ্ধার সাথে তাদের স্মৃতিচারণ করে এলাকার সাধারণ মানুষ, যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে জীবন্ত রাখে। এই ঘটনা শুধু একটি গ্রামের ক্ষতি নয়, বরং সমগ্র বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা নির্যাতিতদের ত্যাগকে স্মরণীয় করে তোলে।
শহীদদের তালিকা: যাদের পরিচয় জানা গেছে
ইকরদিয়া গণহত্যায় শহীদদের মধ্যে যাদের পরিচয় জানা গেছে, তারা হলেন-
এই তালিকাটি শহীদদের পরিচয়কে সংরক্ষিত করে, যা তাদের ত্যাগের স্মারক হিসেবে কাজ করে।
এই গণহত্যা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, যা নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রতীক। এটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে অসংখ্য ত্যাগের মাধ্যমে।
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড [ফারজানা আহমেদ]
মন্তব্য করুন