বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি অসাধারণ সংগ্রাম, যা দেশের অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক স্তরে বহুমুখী প্রচেষ্টার ফলে বিজয়ী হয়েছে। ১৯৭১ সালের মার্চ মাস থেকে শুরু হয়ে ডিসেম্বর পর্যন্ত চলা এই যুদ্ধে প্রতিটি দিন ছিল ঘটনাবহুল, যা দেশীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসিকতা, কূটনৈতিক চাপ এবং আন্তর্জাতিক সমর্থনের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে। এই যুদ্ধের পেছনে ছিল অসংখ্য ব্যক্তি এবং গোষ্ঠীর একক ও যৌথ প্রচেষ্টা, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে অবদান রেখেছে। নিম্নে ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১-এর ঘটনাগুলোর বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া হলো, যা আন্তর্জাতিক কূটনীতি, কূটনৈতিক পক্ষত্যাগ এবং যুদ্ধক্ষেত্রের সংঘর্ষের মতো বিভিন্ন দিককে আলোকপাত করে।
কমনওয়েলথ সম্মেলনে বাংলাদেশ প্রসঙ্গের উত্থাপন
১৯৭১ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে সপ্তদশ কমনওয়েলথ সংসদীয় সম্মেলনের উদ্বোধনী দিনটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য মুহূর্ত হয়ে উঠল। যদিও আলোচ্যসূচিতে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ অন্তর্ভুক্ত ছিল না, তবুও কয়েকজন প্রতিনিধি এই বিষয়টি উত্থাপন করে আন্তর্জাতিক মনোযোগ আকর্ষণ করেন। এই সম্মেলনটি কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সংসদীয় আলোচনার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম ছিল, এবং এখানে বাংলাদেশের সমস্যা উত্থাপিত হওয়া পাকিস্তানের উপর চাপ বাড়িয়ে দিয়েছে।
যুক্তরাজ্যের প্রতিনিধি এবং সাবেক মন্ত্রী আর্থার বটমলি এই প্রসঙ্গটি প্রথম উত্থাপন করেন। তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে অনুরোধ করেন যেন তিনি পূর্ব পাকিস্তানের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। আর্থার বটমলি জোর দিয়ে বলেন যে, শেখ মুজিবুর রহমানই পূর্ব পাকিস্তানের প্রতীক এবং সেখানকার জনগণের পক্ষে কথা বলার একমাত্র অধিকারী ব্যক্তি। তিনি শেখ মুজিবের মুক্তির দাবি করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারের প্রতি আবেদন জানান। এছাড়া, তিনি উল্লেখ করেন যে, ব্রিটেন তার ইতিহাস থেকে শিখেছে যে, জননেতাকে কারাগারে রাখা উচিত নয়, কারণ এটি আরও বড় সংকটের জন্ম দিতে পারে। এই বক্তব্যটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে আন্তর্জাতিক স্তরে বৈধতা প্রদান করেছে এবং পাকিস্তানের সামরিক শাসনের সমালোচনা করেছে।
ভারতের প্রতিনিধিদলের নেতা এবং লোকসভার স্পিকার জি এস ধীলনও এই সম্মেলনে বাংলাদেশের শরণার্থী সমস্যা নিয়ে কথা বলেন। তিনি কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোকে এই সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। ধীলন স্পষ্ট করে বলেন যে, পূর্ববঙ্গের সমস্যা শুধু ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার নয়, বরং পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যকার অভ্যন্তরীণ যুদ্ধের ফলাফল। এই বক্তব্যটি বাংলাদেশের সমস্যাকে আন্তর্জাতিকীকরণ করতে সাহায্য করেছে এবং ভারতের উপর পড়া শরণার্থীদের বোঝা ভাগ করে নেওয়ার দাবি তুলেছে।
এছাড়া, নিউজিল্যান্ডের প্রতিনিধি এইচ সি টেম্পেল্টন তাঁর দেশের পক্ষ থেকে কমনওয়েলথ এবং যুক্তরাজ্যকে পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিকদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য অনুরোধ করেন। এই অনুরোধটি মানবাধিকারের দিক থেকে বাংলাদেশের সংগ্রামকে সমর্থন করেছে এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দিয়েছে।
আরও কূটনীতিকদের পাকিস্তানের পক্ষত্যাগ
মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালি কূটনীতিকদের পাকিস্তান ত্যাগ করে বাংলাদেশের পক্ষে যোগ দেওয়া ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, যা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিভাজনকে প্রকাশ করেছে। ১৩ সেপ্টেম্বর এমনই কয়েকটি পক্ষত্যাগের ঘটনা ঘটে।
ফিলিপাইনে নিযুক্ত পাকিস্তানের বাঙালি রাষ্ট্রদূত খুররম খান পন্নী এই দিন পদত্যাগ করে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। এর আগে ইরাকে নিযুক্ত বাঙালি রাষ্ট্রদূত আবুল ফতেহও পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন। খুররম খান পন্নী পদত্যাগের পর ম্যানিলায় অবস্থান করার সিদ্ধান্ত নেন, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে আন্তর্জাতিক স্তরে শক্তিশালী করেছে।
একই দিনে নাইজেরিয়ার রাজধানী লাগোসে পাকিস্তান হাইকমিশনের বাঙালি চ্যান্সারি কর্মকর্তা মহিউদ্দিন আহমদ জায়গীরদারও পদত্যাগ করেন। তিনি সপরিবার লন্ডন পৌঁছে বাংলাদেশ মিশনে যোগ দেন। মহিউদ্দিন আহমদ পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কূটনীতিক ছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে তাঁকে চ্যান্সারি প্রধান হিসেবে লাগোসে পাঠানো হয়েছিল। এই পক্ষত্যাগগুলো বাংলাদেশের প্রবাসী বাঙালিদের সংগ্রামকে তুলে ধরেছে এবং পাকিস্তানের কূটনৈতিক ফ্রন্টে দুর্বলতা সৃষ্টি করেছে।
দিল্লিতে তাজউদ্দীন আহমদের প্রতিনিধির কার্যক্রম এবং অন্যান্য কূটনৈতিক ঘটনা
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক মুক্তিযুদ্ধের সময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ১৩ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের প্রতিনিধি মঈদুল হাসান ভারতের রাজধানী দিল্লিতে যান। তিনি ভারতের বেসরকারি গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইংয়ের (‘র’) প্রধান রামনাথ কাওয়ের সঙ্গে দেখা করেন। এই সাক্ষাতে তিনি আলাদা একটি বাহিনী হিসেবে মুজিব বাহিনী গঠনের ফলে উদ্ভূত সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন। এই আলোচনাটি মুক্তিযুদ্ধের অভ্যন্তরীণ সমন্বয় এবং ভারতের সমর্থনকে শক্তিশালী করতে সাহায্য করেছে।
দিল্লির কূটনৈতিক মহলে এই দিন সাংবাদিকদের জানানো হয় যে, বাংলাদেশ নিয়ে বোঝানোর ব্যাপারে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিংয়ের শ্রীলঙ্কা সফর ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাধানের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে শ্রীলঙ্কাকে যুক্ত ইশতেহারে বলানো সম্ভব হয়নি। শ্রীলঙ্কা পাকিস্তানি বিমান ও জাহাজকে বাংলাদেশে সেনা ও রসদ পাঠানোর জন্য নামার এবং তেল ভরার সুযোগ দিয়ে আসছিল। তারা আশঙ্কা করছিল যে, বাংলাদেশকে সমর্থন দিলে ভারত এ অঞ্চলে একটি বৃহৎ শক্তি হয়ে উঠবে। এই ব্যর্থতা ভারতের কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জকে তুলে ধরেছে।
এছাড়া, ভারত সফররত যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ এবং ভারতে দেশটির সাবেক রাষ্ট্রদূত জন কেনেথ গলব্রেথ কলকাতায় এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ সমস্যা নিয়ে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন যে, পূর্ব বাংলার জনগণকে অনভিপ্রেত কোনো সরকারের অধীনে রাখলে তা পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের জন্য বিপর্যয়কর হবে। বাংলাদেশ সমস্যার একমাত্র সমাধান হলো সেখানকার জনসাধারণকে তাদের ইচ্ছানুযায়ী সরকার গঠন করতে দেওয়া। এই মন্তব্যটি আন্তর্জাতিক মতামতকে বাংলাদেশের পক্ষে প্রভাবিত করেছে।
পাকিস্তানে রাজনৈতিক ঘটনা
পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও এই দিনটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো করাচিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকের বিষয়বস্তু প্রকাশ করা হয়নি, তবে কূটনৈতিক মহল থেকে জানা যায় যে, ভুট্টো ইয়াহিয়ার কাছে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানান। কিন্তু ইয়াহিয়া ভুট্টোকে জানান যে, এখনই তা সম্ভবপর নয়। এই বৈঠকটি পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সংকটকে আরও গভীর করেছে এবং মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশে যুদ্ধক্ষেত্রের ঘটনা
মুক্তিযুদ্ধের ফ্রন্টলাইনে এই দিনটি মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসিক অপারেশনের সাক্ষী হয়েছে। বিভিন্ন সেক্টরে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সফল আক্রমণ চালানো হয়।
৩ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা আখাউড়া-হরশপুর রেললাইনে মুকুন্দপুরের কাছে ট্যাংকবিধ্বংসী মাইন পুঁতে রিমোট কন্ট্রোল হাতে নিয়ে অবস্থান নেন। পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারবাহী একটি ট্রেন মাইনের ওপরে এলে মুক্তিযোদ্ধারা বিস্ফোরণ ঘটান, যাতে পাকিস্তানি সেনারা হতাহত হয়। এই সেক্টরের আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা শাহবাজপুরে পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থানে আক্রমণ চালান, যাতে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়।
৭ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল রামচন্দ্রপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাঁটি আক্রমণ করে, যাতে কয়েকজন সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়। এই সংঘর্ষে মুক্তিযোদ্ধা দলের একজন শহীদ এবং দুজন আহত হন।
৮ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা হরিনগরে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি গানবোট ও সেনাবোঝাই লঞ্চকে অ্যামবুশ করে। এতে গানবোট ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং লঞ্চ পানিতে ডুবে যায়। এই অপারেশনগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা যুদ্ধের কৌশলকে প্রমাণ করে এবং পাকিস্তানি বাহিনীকে দুর্বল করে।
এই ঘটনাগুলো মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি দিনের মতোই বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথকে এগিয়ে নিয়ে গেছে, যা দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টার সমন্বয়ে অর্জিত হয়েছে।
সূত্র
- বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর তিন ও আট;
- মূলধারা ’৭১, মঈদুল হাসান, ইউপিল, ঢাকা;
- স্বাধীনতাসংগ্রামে প্রবাসী বাঙালি, আবদুল মতিন, র্যাডিক্যাল এশিয়া পাবলিকেশনস, লন্ডন, যুক্তরাজ্য;
- দ্য গার্ডিয়ান ও দ্য টাইমস, লন্ডন, যুক্তরাজ্য, ১৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১;
- আনন্দবাজার পত্রিকা ও যুগান্তর, কলকাতা, ভারত, ১৪ ও ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১।
মন্তব্য করুন