১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে কুষ্টিয়া জেলা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নৃশংসতার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু ছিল। এই জেলায় অসংখ্য গণহত্যা, লুটপাট এবং ধ্বংসযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছে, যা স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত। এর মধ্যে দৌলতপুর উপজেলার গোয়ালগ্রামে সংঘটিত গণহত্যা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, যা ‘গোয়ালগ্রাম বধ্যভূমি’ নামে পরিচিত। এই ঘটনা ঘটে ১৯৭১ সালের ৬ সেপ্টেম্বরের ভোরে, যখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের স্থানীয় সহযোগী রাজাকাররা নিরীহ গ্রামবাসীদের উপর নির্মম আক্রমণ চালায়। এই গণহত্যায় কমপক্ষে ১৭ জন নিরীহ মানুষ নিহত হন, যাদের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা, নারী এবং শিশুরা অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। কিছু সূত্র অনুসারে, এই বধ্যভূমিতে প্রায় অর্ধশত (প্রায় ৫০ জন) গ্রামবাসী এবং মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করা হয়েছে, যা ঘটনার ভয়াবহতাকে আরও বাড়িয়ে তোলে। এই প্রতিবেদনটি সেই ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা প্রদান করবে, যাতে মুক্তিযুদ্ধের এই ট্র্যাজেডির ঐতিহাসিক তাৎপর্য স্পষ্ট হয়।
পটভূমি এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট কুষ্টিয়ায়
কুষ্টিয়া জেলা মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই একটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধক্ষেত্র ছিল। ১৯৭১ সালের মার্চ মাস থেকে এখানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে উঠে। বিশেষ করে, কুষ্টিয়ায় মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সম্মুখযুদ্ধ সংঘটিত হয় ৩০ এবং ৩১ মার্চ, যাতে হানাদারদের শতাধিক সেনা নিহত হয় এবং আমাদের পক্ষে ছয়জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এই যুদ্ধে পাকবাহিনীর পরাজয় তাদের ক্রুদ্ধ করে তোলে, ফলে তারা পরবর্তী মাসগুলোতে নির্বিচারে গণহত্যা চালায়। কুষ্টিয়ায় মোট ৬০ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয় এবং দুই হাজারেরও বেশি নারীর সম্ভ্রমহানি ঘটে। জেলার দৌলতপুর উপজেলা এই নৃশংসতার অন্যতম কেন্দ্র ছিল, যেখানে গোয়ালগ্রামের মতো গ্রামগুলো হানাদারদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়।
গোয়ালগ্রাম কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুর উপজেলার বোয়ালিয়া ইউনিয়নে অবস্থিত। এই গ্রামটি মেহেরপুর জেলার গাংনী উপজেলার রামনগর গ্রামের সংলগ্ন। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই অঞ্চল মুক্তিযোদ্ধাদের একটি শক্ত ঘাঁটি ছিল, যেখানে তারা হানাদারদের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ চালাতেন। পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের দেশীয় সহযোগী রাজাকাররা এই এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতির খবর পেয়ে প্রতিশোধমূলক আক্রমণের পরিকল্পনা করে। ৬ সেপ্টেম্বরের ঘটনা এই প্রতিশোধের একটি উদাহরণ, যা গ্রামবাসীদের উপর নির্মমতার চরম রূপ প্রকাশ করে। এই গণহত্যা শুধুমাত্র একটি স্থানীয় ঘটনা নয়, বরং পাকবাহিনীর সাধারণ কৌশলের অংশ, যাতে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের সমর্থকদের নির্মূল করে এলাকা নিয়ন্ত্রণে আনতে চেয়েছিল।
আক্রমণের বিবরণ এবং গণহত্যা
১৯৭১ সালের ৬ সেপ্টেম্বরের ভোরে, যখন আঁধার এখনো কাটেনি, মেহেরপুরের গাংনীর রামনগর গ্রামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে এক দফা তুমুল যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা দৃঢ় প্রতিরোধ গড়ে তোলেন, কিন্তু যুদ্ধ শেষে ফজরের আজানের আগে তারা গোয়ালগ্রামের আজাহার আলী ফরাজীর বাড়িতে আশ্রয় নেন। স্থানীয় রাজাকাররা এই খবর পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে পৌঁছে দেয়, ফলে হানাদার বাহিনীর একটি দল দ্রুত ওই বাড়িতে আক্রমণ চালায়।
মুক্তিযোদ্ধারা এই আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের চেষ্টা করেন এবং কিছুক্ষণের জন্য হানাদারদের আটকে রাখেন। কিন্তু পাকবাহিনীর উন্নত অস্ত্রশস্ত্র এবং সংখ্যাগত শ্রেষ্ঠত্বের কারণে মুক্তিযোদ্ধারা একপর্যায়ে পিছু হটতে বাধ্য হন। এই সুযোগে হানাদারেরা বাড়িতে প্রবেশ করে নির্বিচারে গুলি চালায়। তারা গৃহকর্তা আজাহার আলী ফরাজীর ছেলে মুক্তিযোদ্ধা তোফায়েল ফরাজী, তাঁর স্ত্রী নিয়াজ বেগম, দুই শিশুকন্যা মালতি (বয়স প্রায় ৫ বছর) ও সহিদা (বয়স প্রায় ৩ বছর), তোফায়েল ফরাজীর শাশুড়ি মোমেজান, মুক্তিযোদ্ধা ইয়াকুব আলী, ওয়াজেদ আলীসহ মোট ১৭ জনকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে। এই হত্যাকাণ্ডে শিশু এবং নারীদেরও রক্ষা করা হয়নি, যা পাকবাহিনীর নৃশংসতার চরম উদাহরণ। কিছু সূত্র অনুসারে, এই বধ্যভূমিতে গোয়ালগ্রাম এবং আশপাশের এলাকা থেকে ধরে আনা মুক্তিযোদ্ধা এবং সাধারণ গ্রামবাসীদের নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়, এবং লাশগুলো ফেলে রাখা হয়। এই ঘটনা গ্রামবাসীদের মধ্যে চরম আতঙ্ক সৃষ্টি করে এবং মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে হানাদারদের দমনমূলক কৌশলের প্রতিফলন ঘটায়।
নিহতদের মধ্যে পরিচিত কয়েকজনের নাম নিম্নরূপ (যাদের পরিচয় নিশ্চিতভাবে জানা গেছে):
এছাড়া অন্যান্য ১০ জন নিহতের পরিচয় স্থানীয় সূত্র থেকে জানা যায়, যারা গ্রামের সাধারণ বাসিন্দা ছিলেন। এই গণহত্যা পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিশোধমূলক কর্মকাণ্ডের অংশ ছিল, যা মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধের পর তাদের আশ্রয়দাতাদের লক্ষ্য করে চালানো হয়েছে।
ধ্বংসলীলা এবং পরিণতি
এই আক্রমণ শুধুমাত্র হত্যাকাণ্ডে সীমাবদ্ধ ছিল না। পাকবাহিনী গ্রামে লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগও চালায়, যাতে অনেক বসতবাড়ি ধ্বংস হয়। কুষ্টিয়া জেলায় মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে এমন অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে, যেমন থানাপাড়া এবং কোহিনুর ভিলায় গণহত্যা, যেখানে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়। গোয়ালগ্রামের এই বধ্যভূমি পরবর্তীকালে স্মৃতিসৌধ হিসেবে সংরক্ষিত হয়েছে, যা শহীদদের স্মরণে নির্মিত। স্বাধীনতার পর কুষ্টিয়া জেলা ১১ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে চূড়ান্তভাবে শত্রুমুক্ত হয়, কিন্তু এই গণহত্যার ক্ষত এখনো স্থানীয় জনগণের মনে রয়ে গেছে।
ঘটনার তাৎপর্য এবং উত্তরাধিকার
গোয়ালগ্রাম গণহত্যা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, যা পাকিস্তানি হানাদারদের গণহত্যা এবং নির্যাতনের নমুনা। এই ঘটনা দেখিয়ে দেয় কীভাবে হানাদাররা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের প্রতিশোধ নিতে নিরীহ শিশু, নারী এবং বয়স্কদেরও হত্যা করেছে। এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বলিদানের প্রতীক, যা ভবিষ্যত প্রজন্মকে স্বাধীনতার মূল্য স্মরণ করিয়ে দেয়। পঞ্চাশ বছর পরও এই ঘটনা স্মরণ করা হয়, এবং স্থানীয় সরকার এই বধ্যভূমিকে সংরক্ষণ করেছে। এই গণহত্যা কুষ্টিয়ার মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগণ্য ভূমিকাকে তুলে ধরে, যা জেলার মানুষের সাহস এবং ত্যাগের সাক্ষ্য বহন করে।
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত
মন্তব্য করুন