১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি রক্তাক্ত এবং ত্যাগের সংগ্রাম, যেখানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের স্থানীয় সহযোগী রাজাকার, আল-বদর ও আল-শামস বাহিনী ব্যাপক গণহত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ এবং নির্যাতন চালিয়েছিল। সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলার রাণীগঞ্জ বাজারে ১ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সালে সংঘটিত গণহত্যা এই নৃশংসতার একটি ভয়াবহ উদাহরণ। এই গণহত্যায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের সহযোগী রাজাকার ও আল-বদরদের হাতে প্রায় দেড় শতাধিক মানুষ নির্মমভাবে হত্যার শিকার হন, যাদের মধ্যে ৫৪ জনের নাম জানা গেছে। হানাদাররা বাজারটি লুণ্ঠন করে এবং ১২৮টি দোকান, ধান ভাঙার কল, করাত কল এবং এমনকি পবিত্র মসজিদে আগুন ধরিয়ে দেয়। এই প্রতিবেদনে রাণীগঞ্জ বাজার গণহত্যার বিস্তারিত বিবরণ, এর পটভূমি, পরিণতি এবং ঐতিহাসিক তাৎপর্য তুলে ধরা হয়েছে।
পটভূমি: রাণীগঞ্জ বাজার ও এর গুরুত্ব
রাণীগঞ্জ বাজার সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলায় কুশিয়ারা নদীর তীরে অবস্থিত একটি জমজমাট বাণিজ্যিক কেন্দ্র। এই বাজারে একটি নৌবন্দর থাকায় এটি ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং সবসময় ব্যস্ত থাকত। জগন্নাথপুর থানা সদর থেকে বাজারটির দূরত্ব প্রায় ৭ কিলোমিটার (প্রায় ৫ মাইল)। এর কৌশলগত অবস্থান এবং অর্থনৈতিক গুরুত্বের কারণে রাণীগঞ্জ বাজার পাকিস্তানি বাহিনীর জন্য একটি লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। এছাড়া, বাজারটি মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক এবং স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কার্যক্রমের কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত ছিল, যা হানাদারদের ক্রোধের কারণ হয়।
গণহত্যার বিবরণ
১ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সালের সকাল ১১টার দিকে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সুবেদার সরফরাজ খানের নেতৃত্বে একটি বড় দল, যার মধ্যে অসংখ্য রাজাকার এবং আল-বদর সদস্য ছিল, জগন্নাথপুর থেকে বেশ কয়েকটি নৌকাযোগে রাণীগঞ্জ বাজারের নৌবন্দরে এসে পৌঁছায়। তাদের এই অভিযানে স্থানীয় দালালরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যাদের মধ্যে ছিলেন জগন্নাথপুর ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান আছাব আলী, হাবিবপুরের আহমদ আলী, রাণীগঞ্জ ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মনোহর আলী, রাজাকার ইয়াহিয়া (রাণীগঞ্জ) এবং দালাল আব্দুর রাজ্জাক। এই দালালদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের সহযোগীরা রাণীগঞ্জ বাজারে প্রবেশ করে।
হানাদাররা প্রথমে শান্তি কমিটি গঠনের কথা বলে বাজারের প্রায় দুই শতাধিক লোককে কৌশলে কুশিয়ারা নদীর তীরে নিয়ে যায়। সেখানে তাদের সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করানো হয় এবং রশি দিয়ে বেঁধে ফেলা হয়। কোনো ধরনের কথা-বার্তা বা জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়াই পাকিস্তানি সেনারা এবং তাদের সহযোগীরা নির্বিচারে গুলি চালায়। সুবেদার সরফরাজ খানের নির্দেশে রাইফেলগুলো গর্জে ওঠে, এবং প্রায় দেড় শতাধিক মানুষ এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। হত্যার পর শহীদদের লাশ কুশিয়ারা নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। এই সময়, প্রায় ৫০ জন ব্যক্তি নদীতে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতরে আত্মরক্ষা করতে সক্ষম হন, যাদের মধ্যে মজমিল আলী, হুসিয়ার আলী, খলিল আহমদ, ওয়াহিদ আলী, জওয়াহেদ আলী, তফাজ্জল আলী, আকলু মিয়া, বিনোদ রায়, আলকাছ আলী, ইদ্রিস আলী এবং ফরিদ আহমদের নাম উল্লেখযোগ্য।
গণহত্যায় শহীদদের মধ্যে ৫৪ জনের নাম জানা গেছে। তারা হলেন--
লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ
গণহত্যার পর পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের সহযোগীরা রাণীগঞ্জ বাজারে ব্যাপক লুণ্ঠন চালায়। তারা নগদ টাকা, স্বর্ণালঙ্কার এবং মূল্যবান জিনিসপত্র হস্তগত করে। সুবেদার সরফরাজ খানের নির্দেশে হানাদাররা বাজারে অগ্নিসংযোগ করে, যার ফলে ১২৮টি দোকান, ধান ভাঙার কল, করাত কল এবং এমনকি স্থানীয় মসজিদ ভস্মীভূত হয়। এই অগ্নিসংযোগ বাজারের অর্থনৈতিক কাঠামোকে ধ্বংস করে দেয় এবং স্থানীয় ব্যবসায়ীদের জীবিকা নির্বাহের উপায় কেড়ে নেয়। দুঃখজনকভাবে, এই লুণ্ঠনে শুধু পাকিস্তানি বাহিনী, রাজাকার, আল-বদর এবং শান্তি কমিটির সদস্যরাই নয়, এলাকার কিছু স্থানীয় লোকজনও অংশ নেয়। কুশিয়ারা নদীতে শহীদদের লাশ ভেসে ওঠার সময়, লুণ্ঠনকারীরা তাদের উপর দিয়ে কোটি কোটি টাকার সম্পদ লুট করে নিয়ে যায়, যা এই ঘটনার নৈতিক অধঃপতনের চিত্র তুলে ধরে।
পরিণতি ও তাৎপর্য
রাণীগঞ্জ বাজার গণহত্যা সুনামগঞ্জ অঞ্চলে পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের সহযোগীদের দ্বারা সংঘটিত নৃশংসতার একটি প্রধান উদাহরণ। এই ঘটনা শুধুমাত্র বাজারের ব্যবসায়ী এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে ভয় ও আতঙ্ক ছড়ায়নি, বরং মুক্তিযুদ্ধের সমর্থকদের উপর দমনমূলক অভিযানের তীব্রতা প্রকাশ করে। এই গণহত্যা শ্রীরামসির ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের পরদিন ঘটেছিল, যা দেখায় যে পাকিস্তানি বাহিনী পরিকল্পিতভাবে সুনামগঞ্জ অঞ্চলে তাদের আধিপত্য ধরে রাখতে এবং প্রতিরোধ দমন করতে চেয়েছিল।
তবে, এই নৃশংসতা মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল ভাঙতে পারেনি। বরং, এটি তাদের প্রতিরোধকে আরও তীব্র করেছিল। ১৯৮৭ সালে জগন্নাথপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু খালেদ চৌধুরীর উদ্যোগে রাণীগঞ্জ হাইস্কুল প্রাঙ্গণে শহীদদের স্মরণে একটি স্মৃতিফলক নির্মিত হয়, যা এই গণহত্যার শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা এবং তাদের ত্যাগের স্মরণকে জীবিত রাখে।
রাণীগঞ্জ বাজার গণহত্যা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায় হিসেবে স্মরণীয়। এটি স্বাধীনতার জন্য স্থানীয় বাসিন্দাদের ত্যাগ এবং সাহসের প্রতীক, যা আগামী প্রজন্মের জন্য প্রেরণা হিসেবে কাজ করে।
সূত্র:
- বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ, ৯ম খণ্ড, শফিউদ্দিন তালুকদার।
- মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত, তাজুল মোহাম্মদ।
মন্তব্য করুন