বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ (১৯৭১) ছিল একটি রক্তাক্ত লড়াই, যেখানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের স্থানীয় সহযোগীরা (রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস) ব্যাপক গণহত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন এবং ধ্বংসলীলা চালিয়েছিল। কিশোরগঞ্জ জেলা এই নৃশংসতার একটি প্রধান কেন্দ্রবিন্দু ছিল, যেখানে অসংখ্য বধ্যভূমি এবং গণকবর সৃষ্টি হয়েছিল। জুলাই মাসের শেষের দিকে কিশোরগঞ্জে আসা পাকিস্তানি মেজর ইফতেখার এই হত্যাযজ্ঞের মূল নায়ক ছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে প্রতিদিন ৩০ থেকে ৫০ বা তারও বেশি মানুষকে ধরে এনে হত্যা করা হতো, যাদের অধিকাংশই হিন্দু সম্প্রদায়ের ছিলেন। এই ধরনের হামলায় হিন্দু অধিবাসীরা ভয়ে শহর ছেড়ে পালাতে শুরু করেন, এবং কেউ কেউ প্রাণভয়ে ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য হন। মেজর ইফতেখার শান্তি কমিটির মাধ্যমে হিন্দুদের আহ্বান জানিয়েছিলেন যে, নির্দোষ কাউকে হয়রানি করা হবে না, কিন্তু বাস্তবে এটি ছিল একটি ছলনা। এই প্রেক্ষাপটে ১ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সালে কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার কলকড়িয়াইল ইউনিয়নের কানকাটি খারপাড় গ্রামে একটি ভয়াবহ গণহত্যা সংঘটিত হয়, যা কানকাটি গণহত্যা নামে পরিচিত।
এই দিনে পাকিস্তানি সৈন্য এবং তাদের সহযোগীরা (স্থানীয় রাজাকাররা) কানকাটি খারপাড় গ্রামে ছাত্রনেতা (বর্তমানে শিক্ষাবিদ) সুধীরচন্দ্র সরকারের বাসায় আকস্মিক হামলা চালায়। এই হামলা ছিল সুনির্দিষ্টভাবে লক্ষ্যবস্তুকৃত, কারণ সুধীরচন্দ্র সরকার মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক ছিলেন এবং তাঁর বাসা সম্ভবত মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়স্থল হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল। হামলাকারীরা বাসায় প্রবেশ করে সেখানে অবস্থানরত ব্যক্তিদের ওপর নির্মমভাবে আক্রমণ করে। এই হামলায় নিহত হন: হর্ষবর্ধন সরকার, সুধীরচন্দ্রের পিতা সুরেন্দ্রচন্দ্র সরকার, বিশ্ববর্ধন সরকার, জ্ঞানচন্দ্র নন্দী, জয়চন্দ্র নন্দী এবং মধুসূদন নন্দী। এই ছয়জন ব্যক্তি সকলেই নিরীহ নাগরিক ছিলেন, যাদের মধ্যে সরকার পরিবারের সদস্যরা প্রধানত হিন্দু সম্প্রদায়ের ছিলেন। হামলাকারীরা এদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করে, যা পাকিস্তানি বাহিনীর ধর্মীয় ও রাজনৈতিক লক্ষ্যবস্তুকরণের একটি উদাহরণ।
হামলার সময় আরও কয়েকজনকে হত্যার উদ্দেশ্যে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এদেরকে সম্ভবত জিজ্ঞাসাবাদ বা নির্যাতনের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়, কিন্তু পরবর্তীতে অজানা কারণে তাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এই ঘটনা কানকাটি গ্রামের বাসিন্দাদের মধ্যে চরম আতঙ্ক সৃষ্টি করে, এবং এটি কিশোরগঞ্জ জেলায় চলমান গণহত্যার ধারাবাহিকতার অংশ ছিল। জেলায় এই ধরনের হামলায় হিন্দু সম্প্রদায়কে বিশেষভাবে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছিল, যার ফলে অনেকে ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য হন বা পালিয়ে যান। কানকাটি গণহত্যা মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতার একটি প্রতীক হয়ে উঠেছে, যা বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের বেদনাদায়ক স্মৃতি।
এই ঘটনার পর কিশোরগঞ্জে আরও অনেক গণহত্যা সংঘটিত হয়, যেমন বড়ইতলা গণহত্যা (১৩ অক্টোবর ১৯৭১), যেখানে শতাধিক মানুষ নিহত হয়। কানকাটি গণহত্যা দেখিয়ে দেয় যে, পাকিস্তানি শাসনের অধীনে বাঙালি, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়, কতটা অসুরক্ষিত ছিল। এই নৃশংসতা মুক্তিবাহিনীর লড়াইকে আরও তীব্র করে তোলে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আজও এই ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায় হিসেবে স্মরণীয়।
সূত্র:
- মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত [৩৯৯]
মন্তব্য করুন