বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি অসাধারণ লড়াই, যা ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত চলেছিল এবং যার পেছনে ছিল দেশীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে অসংখ্য মানুষের প্রচেষ্টা, ষড়যন্ত্র, সামরিক অভিযান এবং রাজনৈতিক মানসিকতা। এই যুদ্ধে প্রতিটি দিনই ছিল ঘটনাবহুল, যা বাঙালি জাতির স্বাধীনতার পথকে প্রভাবিত করেছে। ১ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সালের এই দিনটি ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, কারণ এতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্যের ছড়াছড়ি, পাকিস্তান সরকারের রাজনৈতিক পদক্ষেপ, সামরিক দমনমূলক নির্দেশ এবং মুক্তিবাহিনীর গেরিলা অভিযানের মতো ঘটনা ঘটেছিল। এই প্রতিবেদনে সেই দিনের সকল ঘটনাকে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে, যাতে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং তার প্রভাব স্পষ্ট হয়। এই তথ্যগুলো পাকিস্তানি, ভারতীয়, ব্রিটিশ এবং ফরাসি গণমাধ্যমের প্রতিবেদন, সামরিক দলিল এবং মুক্তিযুদ্ধের সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস থেকে সংগৃহীত।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য এবং আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
১ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবস্থান এবং তাঁর বিরুদ্ধে চলমান বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে পাকিস্তানি সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচারিত হয়, যা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি করে। ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি (Agence France-Presse) করাচির সূত্র থেকে জানায় যে, পাকিস্তানে বন্দী অবস্থায় থাকা শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার শুরু হতে আরও কিছুদিন সময় লাগবে। প্রতিবেদন অনুসারে, ১১ আগস্ট থেকে তাঁর বিচার শুরু হয়েছিল, কিন্তু কোনো পূর্বঘোষণা ছাড়াই তা স্থগিত করা হয়। পরবর্তীতে জানানো হয় যে, শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের বিশিষ্ট আইনজীবী এ কে ব্রোহির সাহায্য পাবেন। তবে, ব্রোহি যখন রাওয়ালপিন্ডিতে আলোচনার জন্য আসেন, তখন তাঁকে বিচারের শুরুর তারিখ সম্পর্কে কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি। এই অস্পষ্টতা শেখ মুজিবের নিরাপত্তা এবং বিচারের নিরপেক্ষতা নিয়ে আন্তর্জাতিক উদ্বেগ বাড়িয়ে তোলে।
করাচির ডেইলি নিউজ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি খবরে 'আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে মুজিবের বিচার হবে' শিরোনামে বলা হয় যে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত আগা শাহি ৩১ আগস্ট জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টকে পাকিস্তান সরকারের নতুন পদক্ষেপগুলো সম্পর্কে অবহিত করেছেন, যাতে দেশে আস্থা বাড়ানো যায়। এরপর নিউইয়র্কে সংবাদদাতাদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে আগা শাহি জানান যে, এই পদক্ষেপগুলো আগামী দু-তিন সপ্তাহের মধ্যে বাস্তবায়িত হবে। শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার সম্পর্কে তিনি বলেন যে, ১১ আগস্ট থেকে বিচার শুরু হয়েছে এবং আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে তা শেষ হয়ে যাবে। তাঁকে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া এবং সহিংসতা উসকে দেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে। যদিও রাষ্ট্রদূত বিচারের স্থান সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করেননি, তবে তিনি উল্লেখ করেন যে, শেখ মুজিবের পছন্দ অনুসারে পাকিস্তানের একজন সেরা সাংবিধানিক আইনজীবী এ কে ব্রোহি তাঁর পক্ষে মামলায় অংশ নিচ্ছেন। এই বক্তব্যগুলো পাকিস্তান সরকারের প্রচারণার অংশ বলে মনে করা হয়, যাতে আন্তর্জাতিক চাপ কমানো যায়।
এছাড়া, ফ্রান্সের দৈনিক পত্রিকা লা ফিগারোর ১ সেপ্টেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত একটি সাক্ষাৎকারে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান স্পষ্ট করে বলেন যে, শেখ মুজিবুর রহমান কারাগারে আছেন এবং তিনি জীবিত। তবে, তিনি কোন কারাগারে আছেন, সে সম্পর্কে তিনি নিজে জানেন না। ইয়াহিয়া খান এই বক্তব্যকে উদাহরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করেন যে, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট কি কোনো বন্দীর জেলের অবস্থান জানেন? এছাড়া, তিনি অভিযোগ করেন যে, ভারত শরণার্থীদের নিজের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কাজে লাগাচ্ছে। এই সাক্ষাৎকারটি শেখ মুজিবের জীবন নিয়ে চলমান গুজব এবং উদ্বেগকে কিছুটা প্রশমিত করলেও, বিচার প্রক্রিয়ার অস্পষ্টতা এবং পাকিস্তানি সরকারের অস্বচ্ছতা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ে সমালোচনার জন্ম দেয়। এই ঘটনাগুলো দেখিয়ে দেয় যে, পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবকে রাজনৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করে রাখতে চাইছিল, যাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে দুর্বল করা যায়।
গভর্নর পরিবর্তন এবং আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক প্রচেষ্টা
এই দিনে পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) গভর্নর হিসেবে ডা. আবদুল মোত্তালিব মালিককে নিয়োগ করে, যা ছিল সামরিক শাসনের অধীনে একটি বেসামরিক প্রশাসনিক পরিবর্তন। যুক্তরাজ্য এবং বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের দূত হিসেবে নিযুক্ত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী লন্ডনে এই নিয়োগের প্রতিক্রিয়ায় বলেন যে, বাংলাদেশে পাকিস্তানের গভর্নর বদলালে বাঙালিদের কিছু যায় আসে না। তাঁর এই মন্তব্য দেখিয়ে দেয় যে, এই ধরনের প্রশাসনিক পরিবর্তন মুক্তিযুদ্ধের মূল সমস্যা সমাধান করতে পারবে না, বরং এটি পাকিস্তানের একটি প্রচারণামূলক পদক্ষেপ।
বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এই দিন লন্ডন থেকে নরওয়ের রাজধানী অসলোতে সফর করেন, যার উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত সৃষ্টি করা। নরওয়ের টেলিভিশনে তাঁর একটি সাক্ষাৎকার নেওয়া হয় এবং সেটি সেই দিনই প্রচারিত হয়, যা ইউরোপীয় দেশগুলোতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সমর্থন বাড়াতে সাহায্য করে।
ব্রিটেনের দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকায় রাওয়ালপিন্ডি থেকে প্রাপ্ত একটি সংবাদে বলা হয় যে, লন্ডনে বাংলাদেশ মিশন স্থাপন করে 'বিদ্রোহী' বাঙালিরা পাকিস্তানবিরোধী কার্যকলাপ পরিচালনা করছে বলে পাকিস্তান সরকার ব্রিটিশ হাইকমিশনারের কাছে প্রতিবাদ জানিয়েছে। প্রতিবাদপত্রে উল্লেখ করা হয় যে, ব্রিটেন পূর্ব পাকিস্তানের বিদ্রোহীদের স্বীকৃতি দেয়নি এবং তাদের অফিস স্থাপনের ব্যাপারে বাধা দেওয়া সম্ভব নয় বলে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ যে ব্যাখ্যা দিয়েছে, তা গ্রহণযোগ্য নয়। এই প্রতিবাদটি দেখিয়ে দেয় যে, পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের কার্যক্রমকে দমন করার চেষ্টা করছিল, কিন্তু আন্তর্জাতিক আইন এবং কূটনীতির কারণে তা সফল হয়নি। এই ঘটনাগুলো মুক্তিযুদ্ধের আন্তর্জাতিক মাত্রাকে আরও প্রসারিত করে।
সামরিক কর্তৃপক্ষের দমনমূলক নির্দেশ এবং বুদ্ধিজীবীদের লক্ষ্যবস্তু করা
পাকিস্তানের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এই দিন ৭৭ নম্বর সামরিক আদেশকে পুনর্গঠন করে ৮৯ নম্বর বিধি জারি করেন। এই আদেশে স্পষ্টভাবে বলা হয় যে, কোনো ব্যক্তি এমন কোনো গুজব ছড়াতে বা সামরিক আইনের সমালোচনা করতে পারবে না, যা পাকিস্তানের অখণ্ডতা বা সংহতিকে বিনষ্ট করতে পারে। এই বিধি ছিল সামরিক শাসনের অধীনে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে আরও সীমিত করার একটি প্রয়াস, যা বাঙালি জনগণের মধ্যে আরও অসন্তোষ সৃষ্টি করে।
এছাড়া, সামরিক কর্তৃপক্ষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক, মোজাফ্ফর আহমদ চৌধুরী, খান সারওয়ার মুরশিদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মাযহারুল ইসলাম, বাংলা একাডেমির আবু জাফর শামসুদ্দিন এবং আরও ১৩ জন সিএসপি (সিভিল সার্ভিস অফ পাকিস্তান) কর্মকর্তাকে ৮ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সামরিক আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয়। এই নির্দেশটি বুদ্ধিজীবী এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের লক্ষ্য করে ছিল, যা মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের পূর্বাভাস দেয়। এই পদক্ষেপগুলো পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দমনমূলক নীতির অংশ ছিল, যা বাঙালি সমাজের মেরুদণ্ড ভাঙার চেষ্টা করেছিল।
মুক্তিবাহিনীর গেরিলা অভিযান: সেক্টরভিত্তিক বিজয়ের পদক্ষেপ
মুক্তিযুদ্ধের মূল শক্তি ছিল মুক্তিবাহিনীর গেরিলা অভিযান, যা এই দিনে বিভিন্ন সেক্টরে সফলভাবে চালানো হয়। ২ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মন্দভাগ এবং নারায়ণপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানের ওপর হামলা চালায়। এই অভিযানে তারা দু-তিনটি বাংকার ধ্বংস করে এবং কয়েকজন পাকিস্তানি সেনাকে হতাহত করে। একই সেক্টরের আরেকটি দল চালনায় হামলা চালিয়ে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা এবং রাজাকারকে হতাহত করে। এছাড়া, ২ নম্বর সেক্টরের গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকা-কুমিল্লা সড়কে দুটি সেতু বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত করে, যার ফলে ঢাকা-কুমিল্লা যোগাযোগ সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। এই অভিযানগুলো পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সরবরাহ লাইনকে দুর্বল করে।
ঢাকায় গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা আজিমপুরে আক্রমণ চালিয়ে রাজাকারদের হতাহত করে, এবং আরেকটি দল টঙ্গীতে রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করে কয়েকজন রাজাকারকে হতাহত করে। এই শহুরে অভিযানগুলো মুক্তিবাহিনীর সাহস এবং কৌশল দেখায়।
মুক্তিবাহিনীর ৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের রঘুনাথপুর ঘাঁটিতে মর্টারের আক্রমণ চালায় এবং আরেকটি দল মহেশকান্দি ঘাঁটিতে হামলা করে, যাতে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। এই অভিযানগুলো সেক্টরটির কৌশলগত গুরুত্ব দেখায়।
অনুরূপভাবে, ১১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা ময়মনসিংহের ভালুকায় পাকিস্তানি সেনা এবং রাজাকারদের ঘাঁটি আক্রমণ করে কয়েকজন রাজাকারকে হতাহত করে। এই সকল অভিযান মুক্তিবাহিনীর সংগঠিত প্রচেষ্টা এবং পাকিস্তানি বাহিনীর মোরাল ভাঙার ক্ষমতা প্রদর্শন করে, যা যুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়ের পথ প্রশস্ত করে।
এই দিনের ঘটনাগুলো মুক্তিযুদ্ধের বহুমুখী চরিত্র দেখায় – রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র থেকে সামরিক লড়াই পর্যন্ত। এগুলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য অমর হয়ে আছে।
সূত্র:
- বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর দুই, আট ও এগারো;
- স্বাধীনতাসংগ্রামে প্রবাসী বাঙালি, আবদুল মতিন, র্যাডিক্যাল এশিয়া পাবলিকেশনস, লন্ডন, ব্রিটেন;
- দ্য টেলিগ্রাফ, লন্ডন, যুক্তরাজ্য, ১ সেপ্টেম্বর ১৯৭১;
- ডেইলি নিউজ, করাচি, পাকিস্তান;
- আনন্দবাজার পত্রিকা ও যুগান্তর, ভারত, ২ ও ৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১।
মন্তব্য করুন