ঢাকা মঙ্গলবার, ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৮ ভাদ্র ১৪৩২
মুক্ত মনমুক্ত চিন্তামুক্তি গাথা

ধোবাজোড়া গণহত্যা | মিটামইন, কিশোরগঞ্জ

প্রিয়ভূমি প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৯:৩৩ পিএম
ধোবাজোড়া গণহত্যা | মিটামইন, কিশোরগঞ্জ

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি রক্তাক্ত এবং বেদনাদায়ক অধ্যায়, যেখানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের স্থানীয় সহযোগী রাজাকার, আল-বদর ও আল-শামস বাহিনী ব্যাপক গণহত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ এবং নির্যাতন চালিয়েছিল। কিশোরগঞ্জ জেলার মিটামইন উপজেলার কেওয়াজোর ইউনিয়নের ধোবাজোড়া গ্রামে ১ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সালে সংঘটিত গণহত্যা এই নৃশংসতার একটি ভয়াবহ উদাহরণ। এই প্রত্যন্ত হাওর গ্রামটি মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়স্থল হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, যা পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের সহযোগী রাজাকারদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। এই গণহত্যায় গ্রামের বেশ কয়েকজন নিরীহ বাসিন্দা শহীদ হন, এবং ব্যাপক লুণ্ঠন ও ধ্বংসযজ্ঞ সংঘটিত হয়। এই প্রতিবেদনে ধোবাজোড়া গণহত্যার বিস্তারিত বিবরণ, এর পটভূমি এবং পরিণতি তুলে ধরা হয়েছে।

পটভূমি: ধোবাজোড়া গ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে এর ভূমিকা

ধোবাজোড়া গ্রাম, কিশোরগঞ্জ জেলার মিটামইন উপজেলার কেওয়াজোর ইউনিয়নের একটি প্রত্যন্ত হাওর অঞ্চলের গ্রাম। এই গ্রামের দুর্গম ভৌগোলিক অবস্থান এটিকে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে গড়ে তুলেছিল। গ্রামের কয়েকজন যুবক মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন রফিকুর রহমান ভূঁইয়া এবং মজিবুর রহমান ভূঁইয়া। এই মুক্তিযোদ্ধারা ধোবাজোড়া গ্রামে বিভিন্ন সময়ে অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করতেন, যা পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের স্থানীয় সহযোগী রাজাকারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। গ্রামটি মুক্তিযুদ্ধের সমর্থকদের কার্যক্রমের কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত হয়, যার ফলে এটি হানাদার বাহিনীর নির্মম আক্রমণের শিকার হয়।

হত্যাকাণ্ডের বিবরণ

১ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সালের সকালে, রাজাকার কমান্ডার কুরবান আলী, মানিক মিল্কী এবং তাদের সহযোগীদের সহায়তায় ক্যাপ্টেন আনোয়ারুল হকের নেতৃত্বে ইটনা ক্যাম্প থেকে আগত পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ধোবাজোড়া গ্রাম ঘিরে ফেলে। এই হামলা ছিল সুনির্দিষ্ট এবং পূর্বপরিকল্পিত, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজে বের করা এবং গ্রামের মানুষের মধ্যে ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করা। হানাদাররা গ্রামে প্রবেশ করার পর সাধারণ মানুষের ওপর নির্বিচারে নির্যাতন ও গুলিবর্ষণ শুরু করে। এই আক্রমণে ঘটনাস্থলে তিনজন গ্রামবাসী শহীদ হন: আব্দুর রউফ রুকন, আনোয়ার আলী এবং বুধু ভূঁইয়া। এছাড়া, গুলিতে মজনু ভূঁইয়া এবং ইদ্রিস মিয়া নামে দুটি শিশু মারাত্মকভাবে আহত হয়, যা পাকিস্তানি বাহিনী এবং রাজাকারদের নির্মমতার চরমতা প্রকাশ করে।

হামলার পর পাকিস্তানি সেনারা এবং রাজাকাররা গ্রামের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের লক্ষ্যবস্তু করে। তারা ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল গনি ভূঁইয়া, নিকলী হাইস্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আব্দুল লতিফ ভূঁইয়া, সিদ্দিকুর রহমান ভূঁইয়া, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রোকনুজ্জামান ভূঁইয়া, আইনের ছাত্র আব্দুল মতিন ভূঁইয়া, কলেজ ছাত্র নূর আলী ভূঁইয়া, হাইস্কুল ছাত্র আব্দুর রশিদ ভূঁইয়া, ইউপি সদস্য আব্দুল মজিদ ভূঁইয়া, আবু জামাল মিয়া এবং চান্দু মিয়াসহ অনেকের ওপর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে তথ্য বের করার জন্য শারীরিক নির্যাতন চালায়। তবে, গ্রামবাসীদের অটল সাহস এবং প্রতিরোধের কারণে হানাদাররা কোনো তথ্য বের করতে ব্যর্থ হয়।

নির্যাতনে ব্যর্থ হয়ে পাকিস্তানি সেনারা এবং রাজাকাররা গ্রামে ব্যাপক লুণ্ঠন চালায়। তারা নগদ টাকা, স্বর্ণালংকার এবং মূল্যবান জিনিসপত্র হস্তগত করে। এছাড়া, তারা অনেক বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়, যা গ্রামের অবকাঠামো এবং জনজীবনে ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। এই অগ্নিসংযোগের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের লুকিয়ে রাখা দুটি গ্রেনেড আগুনের তাপে বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়। এই ঘটনা হানাদারদের আরও উন্মত্ত করে তোলে, এবং তারা আরও বেপরোয়াভাবে তাণ্ডব চালায়।

গণহত্যার পরিণতি: ইটনা ক্যাম্পে হত্যাকাণ্ড

হানাদাররা ধোবাজোড়া গ্রাম থেকে অনেককে বেঁধে ইটনা ক্যাম্পে নিয়ে যায়। ইটনা থানার বয়রা বটমূলে আটককৃত ব্যক্তিদের নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডে শিকার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ২১ জনের পরিচয় জানা গেছে, যাদের মধ্যে ১৮ জন ধোবাজোড়া গ্রামের বাসিন্দা। শহীদদের তালিকা নিম্নরূপ:

  • আব্দুল মজিদ ভূঁইয়া (পিতা: মো. সওদাগর ভূঁইয়া)
  • আব্দুল মতিন ভূঁইয়া (পিতা: আ. মজিদ ভূঁইয়া)
  • আব্দুর রশিদ ভূঁইয়া (পিতা: আ. মজিদ ভূঁইয়া)
  • জহির উদ্দিন ভূঁইয়া (পিতা: শুকুর মাহমুদ ভূঁইয়া)
  • রমিজ উদ্দিন ভূঁইয়া (পিতা: শুকুর মাহমুদ ভূঁইয়া)
  • সিদ্দিকুর রহমান ভূঁইয়া (পিতা: আ. লতিফ ভূঁইয়া)
  • আব্দুল লতিফ ভূঁইয়া (পিতা: সফদর আলী ভূঁইয়া)
  • মো. নূর আলী ভূঁইয়া (পিতা: আমজত আলী ভূঁইয়া)
  • মো. বুধু ভূঁইয়া (পিতা: আমজত আলী ভূঁইয়া)
  • মো. চান্দু মিয়া (পিতা: আব্দুল করিম)
  • মো. সিরাজ মিয়া (পিতা: আব্দুল করিম)
  • মো. রমজান আলী ভূঁইয়া (পিতা: আমজত আলী ভূঁইয়া)
  • আনোয়ার আলী (পিতা: আব্দুল ফকির)
  • আব্দুল গনি ভূঁইয়া, চেয়ারম্যান (পিতা: নাসির উদ্দিন ভূঁইয়া)
  • আব্দুল খালেক ভূঁইয়া (পিতা: আ. ছোবহান ভূঁইয়া)
  • আব্দুর রউফ ভূঁইয়া (পিতা: আ. গনি ভূঁইয়া)
  • আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া (পিতা: আ. আজিজ ভূঁইয়া)
  • রোকনুজ্জামান ভূঁইয়া (পিতা: আ. আজিজ ভূঁইয়া)
  • মো. আবু জামাল ওরফে জাহের মিয়া (পিতা: রাজা মিয়া, সরাইল উপজেলা)
  • আবু জাফর খান
  • মো. রফিক

এই শহীদদের মধ্যে শিক্ষক, ছাত্র, ইউপি চেয়ারম্যান এবং সাধারণ গ্রামবাসী ছিলেন, যারা মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক বা তাদের সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়ার কারণে লক্ষ্যবস্তু হয়েছিলেন। এই হত্যাকাণ্ড গ্রামের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোকে ধ্বংস করে দেয় এবং দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলে।

প্রভাব ও তাৎপর্য

ধোবাজোড়া গণহত্যা মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী এবং রাজাকারদের দ্বারা সংঘটিত ব্যাপক নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডের একটি প্রতীক। এই ঘটনা শুধুমাত্র ধোবাজোড়া গ্রামের বাসিন্দাদের মধ্যে ভয় ও আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়নি, বরং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধকে আরও তীব্র করেছিল। গ্রামের মানুষের সাহস এবং তথ্য গোপন রাখার দৃঢ়তা দেখায় যে, পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতা সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তাদের সমর্থন অটুট ছিল। এই গণহত্যা কিশোরগঞ্জ অঞ্চলে চলমান দমনমূলক অভিযানের অংশ ছিল, যা বাঙালি জাতির মুক্তির সংগ্রামকে আরও দৃঢ় করেছিল।

আজও ধোবাজোড়া গণহত্যা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায় হিসেবে স্মরণীয়। এটি স্বাধীনতার জন্য গ্রামবাসীদের ত্যাগ এবং সাহসের একটি প্রতীক, যা আগামী প্রজন্মের জন্য প্রেরণা হিসেবে কাজ করে।

সূত্র:

- বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ, ৫ম খণ্ড

-শেখ অলিনেওয়াজ অলিউল্লাহ

অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

রাণীগঞ্জ বাজার গণহত্যা | জগন্নাথপুর, সুনামগঞ্জ

ধোবাজোড়া গণহত্যা | মিটামইন, কিশোরগঞ্জ

খারদার গণহত্যা | বাগেরহাট

কানকাটি গণহত্যা, কিশোরগঞ্জে পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতার এক অধ্যায়

১ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: পাকিস্তানি সেনাদের রঘুনাথপুর ঘাঁটিতে মর্টারের আক্রমণ মুক্তিযোদ্ধাদের

৩১ আগস্ট ১৯৭১: সাজিউড়া গণহত্যা (কেন্দুয়া, নেত্রকোনা)

৩১ আগস্ট ১৯৭১: শ্রীরামসি (ছিরামিসি) গণহত্যা

৩১ আগস্ট ১৯৭১: কলাবাগানে পাকিস্তান-অনুগত পুলিশের ওপর হামলা

ক্র্যাক প্লাটুনের অদম্য সাহসিকতা ও ত্যাগের গল্প

৩০ আগস্ট ১৯৭১: দিল্লিতে বাংলাদেশ মিশনের উদ্বোধন

১০

২৮ আগস্ট ১৯৭১: মোগরার বিল গণহত্যা (মোহনপুর, রাজশাহী)

১১

২৮ আগস্ট ১৯৭১: পাকুড়িয়া গণহত্যা (মান্দা, নওগাঁ)

১২

২৮ আগস্ট ১৯৭১: দিরাই ও শাল্লা এলাকা হানাদারমুক্ত হয়

১৩

২৭ আগস্ট ১৯৭১: দেয়াড়া গণহত্যা (খুলনা)

১৪

২৭ আগস্ট ১৯৭১: কচুয়া বধ্যভূমি (বাগেরহাট)

১৫

২৭ আগস্ট ১৯৭১: লাতিন আমেরিকায় পাকিস্তানি গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রস্তাব

১৬

২৬ আগস্ট ১৯৭১: নারী নির্যাতনে ইয়াহিয়ার সৈন্যরা মধ্যযুগের বর্বরতাকে হার মানিয়েছে

১৭

২৫ আগস্ট ১৯৭১: সিলেটে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অমানুষিক অত্যাচার

১৮

২৫ আগস্ট ১৯৭১: মানসা গণহত্যা ও বধ্যভূমি (বাগেরহাট)

১৯

২৭ আগস্ট ১৯৭১: লন্ডনে প্রবাসী সরকারের কূটনীতিক মিশন উদ্বোধন

২০