বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ (১৯৭১) ছিল একটি রক্তাক্ত এবং বেদনাদায়ক যুগ, যেখানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের স্থানীয় সহযোগী রাজাকার, আল-বদর এবং আল-শামস বাহিনী ব্যাপক গণহত্যা, নির্যাতন এবং ধ্বংসলীলা চালিয়েছিল। এই যুদ্ধকালীন সময়ে বাগেরহাট জেলা ছিল এমন একটি অঞ্চল যেখানে রাজাকারদের সক্রিয়তা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিল। তারা আওয়ামী লীগের সমর্থক, মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের আত্মীয়-স্বজনদের লক্ষ্যবস্তু করে নির্মম হামলা চালাতো, যা বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামকে আরও জটিল করে তুলেছিল। এই প্রেক্ষাপটে ১ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সাল (বুধবার, বাংলা ক্যালেন্ডার অনুসারে ১৫ ভাদ্র ১৩৭৮) বাগেরহাটে সংঘটিত খারদার হত্যাকাণ্ড ছিল রাজাকার বাহিনীর বর্বরতার একটি চরম উদাহরণ। এই ঘটনা সরদার আব্দুল জলিলের পরিবারকে কেন্দ্র করে ঘটে, যা একটি নিরীহ পরিবারের উপর অতর্কিত হামলা এবং নির্বিচারে হত্যাকাণ্ডের কথা মনে করিয়ে দেয়।
ঘটনার সূত্রপাত হয় সরদার আব্দুল জলিলের বাড়িতে একজন আগন্তুকের আগমনের খবর থেকে। রাজাকার বাহিনী এই খবর শুনতে পেয়েই সেই রাতে সরদার জলিলের বাড়িতে আকস্মিক হামলা চালায়। আগন্তুক ছিলেন সরদার জলিলের পরিবারেরই একজন আত্মীয়, মোরেলগঞ্জ নিবাসী আব্দুল মোত্তালিব হালদার। তিনি তখন মোরেলগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের অন্যতম সভাপতি হিসেবে পরিচিত ছিলেন, যা রাজাকারদের কাছে তাঁকে একটি লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে। হামলাকারী রাজাকাররা তাঁর পরিচয় জানতে পারামাত্রই নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে। এই হত্যা ছিল রাজনৈতিক প্রতিহিংসার একটি স্পষ্ট উদাহরণ, কারণ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদেরকে তারা বিশেষভাবে নিশানা করতো। আব্দুল মোত্তালিব হালদারের মৃত্যু শুধুমাত্র একটি ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়, বরং মুক্তিযুদ্ধের সমর্থকদের উপর চলমান দমনমূলক অভিযানের অংশ ছিল।
হামলার সময় সরদার আব্দুল জলিল নিজে বাড়িতে উপস্থিত ছিলেন না বা লুকিয়ে ছিলেন, যার ফলে রাজাকাররা তাঁকে খুঁজে পায়নি। কিন্তু তাঁর অনুপস্থিতিতে রাজাকার বাহিনী তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যদের উপর তাদের ক্রোধ প্রকাশ করে। তারা সরদার জলিলের দুই কিশোর পুত্র – দেলোয়ার হোসেন এবং আলতাফ হোসেনকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে। এই দুই কিশোর ছিলেন নিরীহ এবং যুদ্ধের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন না, কিন্তু রাজাকারদের প্রতিহিংসামূলক মানসিকতায় তারা শিকার হয়। হত্যার পদ্ধতি ছিল অত্যন্ত নির্মম, যা সেই সময়ের রাজাকারদের বর্বরতার চিত্র তুলে ধরে। এই ঘটনা দেখায় যে, রাজাকাররা শুধুমাত্র লক্ষ্যবস্তুকৃত ব্যক্তিদের নয়, বরং তাদের পরিবারের সদস্যদেরকেও ছাড় দিত না, যাতে ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি হয় এবং মুক্তিযুদ্ধের সমর্থন কমে যায়।
এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পরিণতি ছিল আরও বেদনাদায়ক। সরদার আব্দুল জলিলের মাতা, যিনি ঐ দুই কিশোরের দাদি ছিলেন, এই ভয়াবহ দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। মানসিক আঘাত এবং দুঃখের তীব্রতায় তিনি কয়েকদিনের মধ্যেই মারা যান। এই মৃত্যু ছিল পরোক্ষভাবে হত্যাকাণ্ডের ফলাফল, যা দেখিয়ে দেয় যে, এমন ঘটনাগুলো শুধুমাত্র প্রত্যক্ষ শিকারদের নয়, বরং সমগ্র পরিবারকে ধ্বংস করে দিত। খারদার হত্যাকাণ্ড সরদার জলিলের পরিবারের জন্য একটি অপূরণীয় ক্ষতি সৃষ্টি করে, এবং এটি বাগেরহাট অঞ্চলে চলমান রাজাকারী দমনের একটি প্রতীক হয়ে ওঠে।
এই হত্যাকাণ্ড মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার বাহিনীর ভূমিকাকে আরও স্পষ্ট করে তুলে ধরে। তারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহায়ক হিসেবে স্থানীয়ভাবে সক্রিয় ছিল এবং আওয়ামী লীগ, মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের সমর্থকদের লক্ষ্য করে হামলা চালাতো। খারদার হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনাগুলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বেদনাদায়ক স্মৃতি হিসেবে আজও স্মরণীয়, এবং এগুলো দেখিয়ে দেয় যে, স্বাধীনতার জন্য কতটা ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। এই ঘটনা বাগেরহাটের ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত।
সূত্র:
- মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত
-[১২৪]স্বরোচিষ সরকার।
মন্তব্য করুন