১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাসে ৬ সেপ্টেম্বর একটি উল্লেখযোগ্য দিন হিসেবে চিহ্নিত। এই দিনে রাজনৈতিক, কূটনৈতিক এবং সামরিক ক্ষেত্রে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে, যা যুদ্ধের গতিপথকে প্রভাবিত করে। মুজিবনগর সরকারের সিদ্ধান্তগুলো থেকে শুরু করে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সতর্কবার্তা, আন্তর্জাতিক সমর্থনের প্রচেষ্টা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ অভিযান—সবকিছু মিলিয়ে এই দিনটি যুদ্ধের একটি গতিশীল অধ্যায়। নিম্নে এই দিনের ঘটনাবলী বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হলো, যাতে সকল তথ্য অক্ষুণ্ণ রাখা হয়েছে এবং প্রসঙ্গের গভীরতা বোঝানোর জন্য বর্ণনা বাড়ানো হয়েছে।
কলকাতায় বাংলাদেশ মিশনের পদবি পরিবর্তন: হাইকমিশন হিসেবে স্বীকৃতি
মুজিবনগরে অবস্থিত বাংলাদেশ সরকারের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র ৬ সেপ্টেম্বর সাংবাদিকদের সাথে কথা বলে জানায় যে, কলকাতায় অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনের নাম এবং তার প্রধানের পদবি পরিবর্তন করা হয়েছে। মিশনের প্রধান হোসেন আলীর পদবি এখন ‘হাইকমিশনার’ হিসেবে পরিবর্তিত হয়েছে, এবং মিশনের নাম হয়েছে ‘বাংলাদেশ হাইকমিশন’। এই সিদ্ধান্তটি বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদের একটি বৈঠকে গৃহীত হয়েছে, যদিও এর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এখনও দেওয়া হয়নি। এই পরিবর্তনের পিছনে ভারতের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক সেলের চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ বিষয়ে বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ডি পি ধরের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। তিনি সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের নেতাদের সাথে আলোচনা করে এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পথ প্রশস্ত করেছেন।
সূত্রটি আরও জানায় যে, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের পররাষ্ট্রসচিব টি এন কাউল ৭ সেপ্টেম্বর মুজিবনগরে আসবেন বাংলাদেশ সরকারের নেতাদের সাথে আলোচনা করার জন্য। তাঁর এই হঠাৎ সফরকে রাজনৈতিক মহলে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। বিশেষ করে, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের আসন্ন অধিবেশনে বাংলাদেশ সরকার যাতে তাদের প্রতিনিধি পাঠাতে পারে, সেজন্য অন্তত একটি দেশের স্বীকৃতি প্রয়োজন। বাংলাদেশ সরকার আশা করছে যে, ভারত সরকার সবার আগে তাদের এই স্বীকৃতি প্রদান করবে। এছাড়া, সরকার কমনওয়েলথ সদস্যভুক্ত হওয়ার ওপরও জোর দিচ্ছে, যা আন্তর্জাতিক মঞ্চে তাদের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করবে।
এছাড়া, অপারেশন ওমেগা দলের চারজন স্বেচ্ছাসেবক, যারা ৫ সেপ্টেম্বর সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছিলেন, তারা এখনও ফিরে আসেননি। এই ঘটনা যুদ্ধের অনিশ্চয়তা এবং ঝুঁকির মাত্রাকে তুলে ধরে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সতর্কবার্তা: সম্পূর্ণ প্রস্তুতি এবং সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তির উল্লেখ
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এই দিনে পাকিস্তানের জঙ্গি শাসকদের সতর্ক করে দিয়ে বলেন যে, ভারত যেকোনো ধরনের আক্রমণ মোকাবিলা করতে এখন সম্পূর্ণ প্রস্তুত। তিনি ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তির উল্লেখ করে জানান যে, পাকিস্তানের সামরিক শাসকেরা যদি কোনো দুঃসাহসিক ঝুঁকি নেন, তাহলে এই চুক্তি তাদের বিরুদ্ধে একটি প্রবল বাধা হয়ে দাঁড়াবে। ফলে তারা হয়তো এমন চিন্তাধারা থেকে নিবৃত্ত হবেন। এই বক্তব্য তিনি জম্মু থেকে ১৬৫ কিলোমিটার দূরে সীমান্তবর্তী রাজৌরিতে একটি সমাবেশে দেন, যা যুদ্ধের সম্ভাব্যতা এবং ভারতের দৃঢ় অবস্থানকে স্পষ্ট করে। এই সতর্কবার্তা কূটনৈতিক চাপ বাড়ানোর একটি কৌশল হিসেবে দেখা হয়, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে পরোক্ষভাবে সমর্থন করে।
আইএনটিইউসির কার্যনির্বাহক কমিটির আবেদন এবং বৈঠক
দিল্লিতে এই দিনে আইএনটিইউসির (Indian National Trade Union Congress) দুই দিনব্যাপী বৈঠক শুরু হয়। এই কার্যনির্বাহক কমিটির বৈঠকে শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বিশ্বের সব রাষ্ট্রের কাছে আবেদন জানানো হয়। বৈঠকে বাংলাদেশের প্রতি একাত্মতা জানিয়ে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়, যা আন্তর্জাতিক সমর্থন বাড়ানোর একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এই ধরনের বৈঠকগুলো যুদ্ধের সময়ে শ্রমিক আন্দোলনের মাধ্যমে রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টির উদাহরণ।
প্রবাসে আবু সাঈদ চৌধুরীর জনসংযোগ প্রচেষ্টা
নরওয়ে সফররত যুক্তরাজ্য ও বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এই দিনে অসলোতে একটি সংবাদ সম্মেলন করেন। সকালে এই সম্মেলনে তিনি মুক্তিযুদ্ধের উদ্দেশ্য, বর্তমান পরিস্থিতি এবং সংগ্রামের অগ্রগতি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পেশ করেন। সন্ধ্যায় তিনি অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের মিলনায়তনে একটি ছাত্র সমাবেশে বক্তব্য দেন। এই সমাবেশে নরওয়ের একজন বিখ্যাত শিল্পীর আঁকা একটি ব্যঙ্গচিত্র পোস্টার হিসেবে ব্যবহার করা হয়, যাতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে নরহত্যাকারী দৈত্যরূপে চিত্রিত করা হয়েছে। এই ধরনের জনসংযোগ প্রচেষ্টা আন্তর্জাতিক মতামত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরে।
পাকিস্তানের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিক্রিয়া
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ব্যক্তিগত দূত সুলতান মহম্মদ খান এই দিনে মস্কোতে সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রে গ্রোমিকোর সাথে সাক্ষাৎ করেন। এছাড়া, তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অন্যান্য কর্মকর্তাদের সাথেও বৈঠক করেন। এই সাক্ষাৎগুলো পাকিস্তানের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার অংশ, যা সোভিয়েত ইউনিয়নকে নিরপেক্ষ রাখার চেষ্টা।
অন্যদিকে, সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র 'প্রাভদা'য় বলা হয় যে, পাকিস্তানের ক্ষমাপ্রদর্শন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়নি। এই মন্তব্য সোভিয়েত ইউনিয়নের অবস্থানকে স্পষ্ট করে, যা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে চাপ বাড়ায়।
অবরুদ্ধ বাংলাদেশে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের কার্যকলাপ
অবরুদ্ধ বাংলাদেশে পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষ এই দিনে ৪৮ জন প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যকে সামরিক আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয়। এই নির্দেশ যুদ্ধের সময়ে রাজনৈতিক দমনমূলক কার্যকলাপের একটি উদাহরণ, যা বাংলাদেশের নেতৃত্বকে দুর্বল করার চেষ্টা।
মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ অভিযান: বিভিন্ন সেক্টরের ঘটনা
যুদ্ধের ময়দানে এই দিনে মুক্তিযোদ্ধাদের একাধিক সফল অভিযান ঘটে, যা পাকিস্তানি বাহিনীকে চাপে ফেলে।
এক নম্বর সেক্টর: এই সেক্টরের অধীন একদল গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা চট্টগ্রামে পোলো গ্রাউন্ডের প্রবেশমুখে পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের ওপর গ্রেনেড আক্রমণ চালায়। এতে দু-তিনজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। এই আক্রমণ গেরিলা যুদ্ধের কৌশলগত সাফল্য দেখায়।
ফেনী অভিযান: ফেনীতে মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাকিস্তানি সেনাদের সিলোনিয়া নদী অতিক্রমের সময় আক্রমণ করে। এতে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন সেনা হতাহত হয়। এই ধরনের নদীভিত্তিক অভিযান যুদ্ধের ভূখণ্ডীয় সুবিধা ব্যবহারের উদাহরণ।
শরীয়তপুর জেলা: শরীয়তপুর জেলায় ২০ জনের একটি গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা দল পালং থানার রাজগঞ্জের কাছে নদীর পারে অ্যামবুশ পাতে। পাকিস্তানি সেনারা লঞ্চে মাদারীপুরে যাওয়ার পথে এই অ্যামবুশে পড়ে, এবং গেরিলারা আক্রমণ চালায়। যুদ্ধের একপর্যায়ে পাকিস্তানি সেনারা লঞ্চ নিয়ে পালিয়ে যায়। এই যুদ্ধে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। এই অভিযান মুক্তিযোদ্ধাদের কৌশলগত দক্ষতা প্রমাণ করে।
৬ নম্বর সেক্টর: এই সেক্টরের ৩০ জনের একটি মুক্তিযোদ্ধা দল মোগলহাট রেললাইনের ওপর অ্যান্টি-ট্যাংক মাইন, গ্যালাটিন ও পিইকে বসিয়ে অবস্থান নেয়। পাকিস্তানি সেনাবাহী একটি ট্রেন অগ্রসর হলে মাইন বিস্ফোরণে ইঞ্জিনসহ সামনের কয়েকটি বগি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের তিন দিক থেকে পাল্টা আক্রমণ করে। যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন হতাহত হয়। মুক্তিযোদ্ধা দলের দুজন শহীদ এবং কয়েকজন আহত হন। এই অভিযান রেল যোগাযোগ ব্যাহত করার কৌশল দেখায়।
৭ নম্বর সেক্টর: এই সেক্টরের মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাকিস্তানি বাহিনীর প্রেমতলী অবস্থানে আক্রমণ চালায়। এতে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়। এই আক্রমণগুলো যুদ্ধের ময়দানে মুক্তিযোদ্ধাদের অদম্য সাহসের প্রতীক।
এই ঘটনাবলী ১৯৭১ সালের ৬ সেপ্টেম্বরকে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন করে তুলেছে, যা রাজনৈতিক কূটচাল থেকে শুরু করে যুদ্ধের ময়দানের বীরত্ব পর্যন্ত সবকিছুকে অন্তর্ভুক্ত করে।
সূত্র:
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ১, ২, ৬ ও ৭;
স্বাধীনতাসংগ্রামে প্রবাসী বাঙালি, আবদুল মতিন, র্যাডিক্যাল এশিয়া পাবলিকসেন্স, লন্ডন;
আনন্দবাজার পত্রিকা ও যুগান্তর, কলকাতা, ভারত, ৭ ও ৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭১।
মন্তব্য করুন