১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে কিশোরগঞ্জ জেলার নিকলী উপজেলার গুরই গ্রামে সংঘটিত গণহত্যা একটি ভয়াবহ ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত। এই গণহত্যা ঘটে ৬ই সেপ্টেম্বর, যখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের দেশীয় সহযোগীরা গ্রামটিতে নির্বিচারে হামলা চালায়। এই আক্রমণে বেশ কয়েকজন নিরীহ সাধারণ মানুষ শহীদ হন, যাদের মধ্যে পুরুষ, নারী এবং অন্যান্য গ্রামবাসী অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। এই ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায় হিসেবে স্মরণীয়, যা পাকবাহিনীর নৃশংসতা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসিকতার একটি উদাহরণ। গুরই গণহত্যা শুধুমাত্র একটি স্থানীয় ঘটনা নয়, বরং এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়কালীন হানাদারদের দমনমূলক কৌশলের প্রতিফলন।
পটভূমি এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট
মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয় মাসের সময়কালে কিশোরগঞ্জ জেলার হাওর অঞ্চল একটি মুক্তাঞ্চল হিসেবে পরিচিত ছিল। এই এলাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কখনোই স্থায়ী ঘাঁটি স্থাপন করতে সক্ষম হয়নি। হাওরের ভৌগোলিক অবস্থান এবং স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের দৃঢ় প্রতিরোধের কারণে এই অঞ্চল পাকবাহিনীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল। বিশেষ করে, জেলার নিকলী উপজেলার গুরই গ্রাম এবং সংলগ্ন বাজিতপুর উপজেলার হিলচিয়া বাজারে মুক্তিযোদ্ধাদের স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপিত ছিল। এই ক্যাম্পগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল এবং আক্রমণের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে কাজ করত।
গুরই গ্রামের মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধের শুরু থেকেই পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের স্থানীয় সহযোগীদের (দোসরদের) বিরুদ্ধে সক্রিয় আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এই আক্রমণগুলোতে পাকবাহিনী এবং তাদের দোসররা বারবার নাস্তানাবুদ হয়েছে। ফলে, গুরই গ্রাম পাকবাহিনীর বিশেষ লক্ষ্যস্থলে পরিণত হয়। হানাদাররা এই গ্রামটিকে ধ্বংস করার সুযোগ খুঁজছিল, যাতে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তি দুর্বল করতে পারে এবং স্থানীয় জনগণের মধ্যে ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে। এই পটভূমিতে, ৬ই সেপ্টেম্বর তারা একটি পূর্বপরিকল্পিত আক্রমণ চালায়, যা গুরই গণহত্যা হিসেবে ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয়েছে।
আক্রমণের বিবরণ এবং প্রতিরোধ
৬ই সেপ্টেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের সহযোগীরা পূর্বপরিকল্পিতভাবে গুরই গ্রামে হামলা করে। গ্রামে প্রবেশ করার সাথে সাথেই তারা নির্বিচারে কয়েকজন লোককে হত্যা করে। এরপর, তারা বিভিন্ন বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে এবং লুটপাট চালায়। এই আক্রমণের উদ্দেশ্য ছিল গ্রামটিকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সমর্থকদের নির্মূল করা। পাকবাহিনীর এই নৃশংসতা গ্রামবাসীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে, কিন্তু এটি মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের আগুনকেও জ্বালিয়ে তোলে।
এই আক্রমণের খবর পেয়ে হিলচিয়া ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধারা দ্রুত প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তারা পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতি-আক্রমণ চালান, যাতে ৫ জন পাকিস্তানি সেনা এবং তাদের কয়েকজন দেশীয় দোসর নিহত হয়। এই প্রতিরোধ মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস এবং দৃঢ়তার প্রমাণ। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনীর সর্বাত্মক আক্রমণ এবং উন্নত অস্ত্রশস্ত্রের মুখে মুক্তিযোদ্ধারা এক পর্যায়ে পশ্চাদপসরণে বাধ্য হন। এই পশ্চাদপসরণের পর পাকসেনারা আরও ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে এবং গ্রামে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ এবং নির্বিচার হত্যাকাণ্ড চালায়। তারা বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়িঘরগুলোকে লক্ষ্য করে জ্বালিয়ে দেয়।
ধ্বংসলীলা এবং হত্যাকাণ্ড
পাকবাহিনীর আক্রমণ শুধুমাত্র যুদ্ধের কৌশল ছিল না, বরং এটি একটি পূর্ণাঙ্গ গণহত্যা। তারা গ্রামের পূর্বপাড়ায় ৮৮টি বাড়ি এবং মসজিদপাড়ায় ৭টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। এছাড়া, বহু বাড়িতে লুটতরাজ চালায়, যাতে গ্রামবাসীদের সম্পত্তি লুণ্ঠন করে। হানাদাররা এখানে লুণ্ঠন এবং অগ্নিসংযোগ করেই ক্ষান্ত হয়নি; তারা নির্বিচারে গুলি করে অনেক নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে। কয়েকজনকে তো জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়, যা মানবতার বিরুদ্ধে একটি চরম অপরাধ।
ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনায় দেখা যায়, গ্রামের খুর্শিদ মিয়ার বাড়িতে অনেককে ধরে নিয়ে ব্রাশফায়ারে হত্যা করা হয়। এছাড়া, নবী নেওয়াজের বাড়িতে ছয়জন নারী-পুরুষ তাদের গুলিতে নিহত হয়। পুরো গ্রামের বিভিন্ন জায়গায় লাশের পর লাশ ছড়িয়ে ছিল, যা এই গণহত্যার ভয়াবহতাকে চিত্রিত করে। এই আক্রমণে নিহতদের মধ্যে কমপক্ষে ২৫ জনের পরিচয় নিশ্চিতভাবে জানা গেছে। এই শহীদরা ছিলেন সাধারণ গ্রামবাসী, যাদের মধ্যে পুরুষ, নারী এবং বিভিন্ন বয়সের লোক অন্তর্ভুক্ত। তাদের নাম এবং পরিচয় নিম্নরূপ:
এই নিহতরা গুরই গ্রামের সাধারণ জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে, যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় হানাদারদের নৃশংসতার শিকার হয়েছেন। তাদের মৃত্যু বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য দেওয়া বলিদানের একটি অংশ।
ঘটনার তাৎপর্য এবং উত্তরাধিকার
গুরই গণহত্যা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, যা পাকবাহিনীর গণহত্যা এবং ধ্বংসযজ্ঞের নমুনা। এই ঘটনা দেখিয়ে দেয় কীভাবে হানাদাররা স্থানীয় প্রতিরোধকে দমন করার জন্য নিরীহ জনগণকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছে। যদিও মুক্তিযোদ্ধারা পশ্চাদপসরণ করেছেন, তাদের প্রতিরোধ পাকবাহিনীর শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করেছে এবং পরবর্তীকালে যুদ্ধের গতিপথকে প্রভাবিত করেছে। এই গণহত্যা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিতে একটি স্থায়ী স্থান দখল করে আছে, যা ভবিষ্যত প্রজন্মকে স্বাধীনতার মূল্য স্মরণ করিয়ে দেয়।
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড [মহিবুর রহিম]
মন্তব্য করুন