১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি রক্তাক্ত সংগ্রাম, যেখানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের স্থানীয় সহযোগী রাজাকাররা বাঙালি জনগণের উপর নির্মম অত্যাচার চালিয়েছিল। এই যুদ্ধকালীন সময়ে অসংখ্য গণহত্যা, লুণ্ঠন এবং ধ্বংসযজ্ঞ ঘটেছে, যা আজও বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গভীর ক্ষত হিসেবে অবশিষ্ট রয়েছে। খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলায় অবস্থিত শোভনা গ্রামে ১০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সালে ঘটে যাওয়া গণহত্যা এমনই একটি ঘটনা, যা পাতিবুনিয়া গণহত্যার অল্প কিছুদিন পরে সংঘটিত হয়। এই ঘটনায় পাকিস্তানি সেনা এবং রাজাকারদের দ্বারা নির্মমভাবে হত্যা করা হয় ৪৩ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে। এই প্রতিবেদনে আমরা এই ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ, পটভূমি, আক্রমণের ধরন, পরিণতি এবং সাক্ষ্যপ্রমাণ নিয়ে আলোচনা করব, যাতে ইতিহাসের এই অন্ধকার অধ্যায়টি স্মরণীয় হয়ে ওঠে।
মুক্তিযুদ্ধের সাধারণ পটভূমি এবং খুলনার পরিস্থিতি
১৯৭১ সালের মার্চ মাস থেকে শুরু হওয়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) জনগণের স্বাধীনতার জন্য একটি নির্মম লড়াই। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী 'অপারেশন সার্চলাইট' নামে একটি সামরিক অভিযান চালিয়ে বাঙালি বুদ্ধিজীবী, ছাত্র, রাজনৈতিক নেতা এবং সাধারণ জনগণকে লক্ষ্য করে গণহত্যা শুরু করে। এই যুদ্ধে প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষ নিহত হয় এবং কয়েক লক্ষ নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। খুলনা জেলা, যা দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল, এই যুদ্ধের সময় অসংখ্য গণহত্যার সাক্ষী হয়েছে। চুকনগর গণহত্যা (২০ মে ১৯৭১), যেখানে প্রায় ১০,০০০ থেকে ১২,০০০ বাঙালি হিন্দু শরণার্থীকে হত্যা করা হয়, খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলায় ঘটে যাওয়া একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এই অঞ্চলে পাকিস্তানি সেনা এবং রাজাকাররা হিন্দু-সংখ্যাগরিষ্ঠ গ্রামগুলোকে বিশেষভাবে লক্ষ্য করে আক্রমণ চালাত, যাতে শরণার্থীদের ভারতে পালানো রোধ করা যায় এবং স্থানীয় প্রতিরোধ ভেঙে দেওয়া যায়। শোভনা গণহত্যা এই ধারাবাহিকতার একটি অংশ, যা পাতিবুনিয়া গণহত্যার (যা শোভনার কাছাকাছি ঘটে) অল্প কিছুদিন পরে সংঘটিত হয়। এই ঘটনাগুলো দেখায় যে খুলনা অঞ্চলে পাকিস্তানি বাহিনীর অভিযান ছিল পরিকল্পিত এবং নির্মম।
শোভনা গণহত্যার পটভূমি
শোভনা গ্রাম খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলায় অবস্থিত একটি ছোট্ট গ্রাম, যা ভদ্রা, ঘ্যাংরাইল এবং ঝিলা নদীর বিভিন্ন শাখা দিয়ে ঘেরা। এই নদীগুলো গ্রামের চারপাশে একটি প্রাকৃতিক বাধা তৈরি করেছে, যা যুদ্ধকালীন সময়ে আক্রমণকারীদের জন্য সুবিধাজনক ছিল। পাতিবুনিয়া গণহত্যার (যা শোভনার কাছাকাছি ঘটে এবং যেখানে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা নিরীহ গ্রামবাসীদের হত্যা করে) অল্প কিছুদিন পরে, অর্থাৎ ১০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সালে, পাকিস্তানি সেনা এবং রাজাকাররা শোভনা গ্রামকে লক্ষ্য করে একটি আক্রমণের পরিকল্পনা করে। এই অভিযানটি সম্ভবত একটি ব্যাপক অপারেশনের অংশ ছিল, যার উদ্দেশ্য ছিল স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের দমন করা এবং গ্রামবাসীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করা। খুলনা অঞ্চলে এই ধরনের অভিযানগুলো প্রায়শই হিন্দু-সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় কেন্দ্রীভূত ছিল, কারণ পাকিস্তানি বাহিনী তাদের 'শত্রু' হিসেবে দেখত। পাতিবুনিয়া ঘটনার পর শোভনা গ্রামের বাসিন্দারা ইতিমধ্যেই আতঙ্কিত ছিলেন, কিন্তু তারা আশা করেননি যে এত তাড়াতাড়ি আরেকটি আক্রমণ আসবে।
আক্রমণের বিবরণ
১০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সালে, পাকিস্তানি সেনা এবং রাজাকাররা শোভনা গ্রামের চারপাশ দিয়ে ভদ্রা, ঘ্যাংরাইল এবং ঝিলা নদীর বিভিন্ন শাখা ব্যবহার করে আক্রমণ চালায়। তারা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রে সজ্জিত ছিল, যা তাদেরকে গ্রামে দ্রুত প্রবেশের সুবিধা দিয়েছিল। নদীপথগুলো ব্যবহার করে তারা গ্রামকে ঘিরে ফেলে, যাতে গ্রামবাসীরা পালাতে না পারে। এই আক্রমণটি সম্ভবত একটি ব্যাপক অভিযানের পরিকল্পনা ছিল, যার মাধ্যমে পুরো অঞ্চলটিকে নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সেদিনের আবহাওয়া এবং ভূমির অবস্থা তাদের পরিকল্পনায় বাধা সৃষ্টি করে। রাস্তাগুলো কর্দমাক্ত (কাদামাটি ভর্তি) ছিল, যার ফলে পাকিস্তানি সেনারা বেশিদূর অগ্রসর হতে পারেনি। এই কারণে তারা গ্রামের অভ্যন্তরে পুরোপুরি প্রবেশ করতে না পারলেও, তারা গ্রামের বিভিন্ন স্থানে এবং পার্শ্ববর্তী ভদ্রদিয়া গ্রামে আক্রমণ চালায়। তারা অনেকগুলো বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়, যা গ্রামবাসীদের সম্পত্তি ধ্বংস করে এবং আতঙ্ক ছড়ায়। এই আগুন লাগানোর ঘটনা যুদ্ধকালীন সময়ে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি সাধারণ কৌশল ছিল, যা তারা গ্রামগুলোকে শাস্তি দেওয়ার জন্য ব্যবহার করত।
পরিণতি এবং হতাহতের সংখ্যা
শোভনা গণহত্যার ফলে গ্রামের বিভিন্ন অংশে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ঘটে। আক্রমণকারীরা গুলি চালিয়ে এবং আগুন লাগিয়ে নিরীহ গ্রামবাসীদের হত্যা করে। জানা যায় যে এই ঘটনায় মোট ৪৩ জন নিহত হয়েছিলেন। এই সংখ্যাটি যদিও চুকনগরের মতো বড় গণহত্যার তুলনায় কম, কিন্তু এটি স্থানীয় সম্প্রদায়ের উপর গভীর প্রভাব ফেলে। নিহতদের মধ্যে ছিলেন সাধারণ কৃষক, নারী এবং শিশু, যারা কোনো প্রতিরোধের সুযোগ না পেয়ে প্রাণ হারান। পার্শ্ববর্তী ভদ্রদিয়া গ্রামেও অনেক বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়, যা আশেপাশের অঞ্চলগুলোতে আতঙ্ক ছড়ায়। এই ঘটনার পর শোভনা এবং ভদ্রদিয়ার বাসিন্দারা ভারতে শরণার্থী হিসেবে পালাতে বাধ্য হন, যা মুক্তিযুদ্ধের সময়কার একটি সাধারণ চিত্র। এই গণহত্যা খুলনা অঞ্চলে পাকিস্তানি বাহিনীর জেনোসাইডাল কার্যকলাপের একটি উদাহরণ, যা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
সাক্ষ্য এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা
এই ঘটনার সাক্ষ্য হিসেবে উল্লেখযোগ্য হলো বিপ্লবী কামাক্ষ্যাপ্রসাদ রায় চৌধুরীর সাক্ষাৎকার, যিনি ভদ্রদিয়া গ্রামের (ডুমুরিয়া) বাসিন্দা। ২৭ জুলাই ২০১৪ সালে নেওয়া এই সাক্ষাৎকারে তিনি ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন, যা শোভনা গণহত্যার প্রত্যক্ষ প্রমাণ। তিনি উল্লেখ করেছেন যে আক্রমণকারীরা নদীপথ ব্যবহার করে এসেছিল এবং কর্দমাক্ত রাস্তার কারণে তাদের অভিযান সীমিত হয়ে পড়ে। এই ধরনের সাক্ষাৎকারগুলো ইতিহাস গবেষকদের জন্য অমূল্য, কারণ এগুলো যুদ্ধের সময়কার মৌখিক ইতিহাস সংরক্ষণ করে। শোভনা গণহত্যা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের অসংখ্য নির্মম ঘটনার মধ্যে একটি, যা পাকিস্তানি সেনা এবং রাজাকারদের বর্বরতার সাক্ষ্য বহন করে। এই ঘটনা না শুধু ৪৩ জনের প্রাণহানি ঘটিয়েছে, বরং স্থানীয় সম্প্রদায়কে চিরকালের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। আজকের প্রজন্মের জন্য এই ঘটনা স্মরণ করা জরুরি, যাতে ইতিহাসের ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়া যায় এবং এমন অত্যাচারের পুনরাবৃত্তি রোধ করা যায়। খুলনা অঞ্চলের অন্যান্য গণহত্যার মতো এটিও বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল্যের স্মারক।
সূত্র:
একাত্তরে খুলনা মানবিক বিপর্যয়ের ইতিহাস - দিব্যদ্যুতি সরকার।
সাক্ষাৎকার: বিপ্লবী কামাক্ষ্যাপ্রসাদ রায় চৌধুরী (ভদ্রদিয়া, ডুমুরিয়া), ২৭ জুলাই ২০১৪।
মন্তব্য করুন