ঢাকা রবিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ৩০ ভাদ্র ১৪৩২
মুক্ত মনমুক্ত চিন্তামুক্তি গাথা

কাঁঠালতলা গণহত্যা (ফকিরহাট, বাগেরহাট)

প্রিয়ভূমি প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০১:৪৩ পিএম
প্রতীকী ছবি

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কালে, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের স্থানীয় সহযোগী রাজাকারদের দ্বারা অসংখ্য গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে, যা দেশের ইতিহাসে নৃশংসতার চিহ্ন রেখে গেছে। এর মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো কাঁঠালতলা গণহত্যা, যা খুলনা বিভাগের বাগেরহাট জেলার ফকিরহাট থানায় অবস্থিত কাঁঠালতলা গ্রামে ঘটে। এই গণহত্যা ১৯৭১ সালের ৫ সেপ্টেম্বর, রোববার (বাংলা ক্যালেন্ডার অনুসারে ১৯ ভাদ্র ১৩৭৮) সংঘটিত হয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী (মিলিটারি) এবং রাজাকারদের যৌথ অভিযানে এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়, যাতে ৪৫ জন নিরীহ নর-নারী শহীদ হন। এই ঘটনা শুধুমাত্র হত্যাকাণ্ড নয়, বরং লুটপাট, অগ্নিসংযোগ এবং নির্যাতনের একটি সম্মিলিত ধ্বংসলীলা ছিল, যা গ্রামের মানুষের জীবনে চিরকালের আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে।

ঘটনার পটভূমি এবং কারণসমূহ

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালিদের স্বাধীনতা আন্দোলনকে দমন করার জন্য নির্মম নীতি গ্রহণ করে। বাগেরহাট অঞ্চলটি মুক্তিযোদ্ধাদের সক্রিয়তার কারণে পাকসেনার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। ফকিরহাট থানার কাঁঠালতলা গ্রামটি ছিল একটি শান্তিপূর্ণ গ্রামীণ এলাকা, যেখানে সাধারণ কৃষক এবং পরিবারগুলো বাস করত। পাকসেনা এবং রাজাকাররা এই অঞ্চলে অভিযান চালিয়ে স্বাধীনতাকামীদের দমন করার উদ্দেশ্যে এই হত্যাকাণ্ড ঘটায়। এই অভিযানের পেছনে ছিল রাজনৈতিক প্রতিহিংসা এবং আতঙ্ক সৃষ্টির লক্ষ্য, যাতে গ্রামবাসীরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ না করে।

অভিযানটি শুরু হয় ঘোড়ারপাড় হয়ে, এবং এটি কাঠিরা এবং আসকর কালিবাড়ি পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। পাকসেনারা গৌরনদী ছাউনি থেকে এসে এই অভিযান চালায়, যা সকাল ৮টা থেকে বেলা প্রায় ২/৩টা পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এই সময়কালে তারা গ্রামে অতর্কিত হানা দেয় এবং নির্বিচারে হত্যা, লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগ করে।

ঘটনার বিবরণ: নৃশংস ধ্বংসযজ্ঞ

৫ সেপ্টেম্বর সকালে পাকিস্তানি মিলিটারি এবং রাজাকাররা কাঁঠালতলা গ্রামে প্রবেশ করে। তারা গ্রামবাসীদের উপর গুলি চালায়, যাতে অসংখ্য মানুষ মিলিটারিদের গুলিতে মারা যায়। যারা পালাতে পারেনি, তাদের উপর চরম নির্যাতন চালানো হয়। বিশেষ করে, গ্রাম থেকে যেসব মেয়ে পালাতে পারেনি, তাদের কয়েকজন রাজাকার ও মিলিটারিদের হাতে নির্যাতিতা হন। এই নির্যাতনের ঘটনাগুলো যুদ্ধকালীন নারী নির্যাতনের একটি ভয়াবহ উদাহরণ।

এছাড়া, একটি বিশেষ নৃশংস ঘটনা ছিল একজন বৃদ্ধের প্রতি অত্যাচার। তিনি ঘর থেকে বের হতে পারেননি, এবং ঘাতকরা তাকে ঘরের মধ্যে রেখে ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে তিনি জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মারা যান। অভিযানের সময় মানুষ হত্যা করার পাশাপাশি ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয় এবং সম্পত্তি লুট করা হয়। এই ধ্বংসলীলা সকাল ৮টা থেকে বেলা ২/৩টা পর্যন্ত চলে, এবং তারপর সেনারা গৌরনদী ছাউনিতে ফিরে যায়।

অভিযানের পরিধি ছিল ঘোড়ারপাড় থেকে শুরু করে কাঠিরা এবং আসকর কালিবাড়ি পর্যন্ত। এই এলাকায় পাকবাহিনী নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায়, যাতে মোট ৪৫ জন নিরীহ নর-নারী শহীদ হন। এই হত্যাকাণ্ডে শুধুমাত্র পুরুষ নয়, নারী এবং সম্ভবত শিশুরাও শিকার হয়েছে, যা যুদ্ধের নিয়ম লঙ্ঘনের একটি চরম দৃষ্টান্ত।

হতাহত এবং পরবর্তী ঘটনা

এই গণহত্যায় ৪৫ জন নিরীহ মানুষ প্রাণ হারান। ধ্বংসযজ্ঞ শেষে, যাদের পরিচয় পাওয়া যায়, তাদের লাশ আত্মীয়-স্বজনরা নিয়ে যায়। বাকি লাশগুলো গ্রামবাসীরা সৎকার করে। এই ঘটনা গ্রামের মানুষের মনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে, এবং এটি মুক্তিযুদ্ধের বলিদানের একটি প্রতীক হয়ে ওঠে।

ঐতিহাসিক গুরুত্ব এবং স্মৃতিসৌধ

কাঁঠালতলা গণহত্যা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতনের একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। এই ঘটনা থেকে বোঝা যায় যে কীভাবে স্থানীয় রাজাকাররা তাদের নিজের দেশবাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছে। শহীদদের স্মরণে ‘কাঠিরা শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ’ নির্মিত হয়েছে, যা আজও এই নৃশংসতার সাক্ষ্য বহন করে। এই স্মৃতিস্তম্ভ গ্রামবাসীদের জন্য একটি পবিত্র স্থান, যা স্বাধীনতার জন্য দেওয়া বলিদানের স্মৃতি জাগরূক রাখে।

এই গণহত্যা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে স্বাধীনতা অর্জনের পথ কতটা রক্তাক্ত ছিল, এবং ভবিষ্যতে এমন নৃশংসতা প্রতিরোধের জন্য ঐক্যবদ্ধ থাকার প্রয়োজনীয়তা।

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত

অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: শেখ মুজিবুর রহমানই পূর্ব পাকিস্তানের প্রতীক

১২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন

কৃষ্ণপুর-ধনঞ্জয় গণহত্যা (কুমিল্লা আদর্শ সদর)

১১ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: ভুটানের রাজার শরণার্থীশিবির পরিদর্শন, অপ্রত্যাশিত সমর্থন

শোভনা গণহত্যা (খুলনা)

উদয়পুর গণহত্যা (মোল্লাহাট, বাগেরহাট)

১০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: মুক্তিযোদ্ধাদের অদম্য সাহস এবং পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সফল প্রতিরোধ

৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের এক গুরুত্বপূর্ণ দিন

ঘোড়াইল গণহত্যা (কেন্দুয়া, নেত্রকোনা)

৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আন্তর্জাতিক চাপ এবং গেরিলা অভিযানের দিন

১০

কাঁঠালতলা গণহত্যা (ফকিরহাট, বাগেরহাট)

১১

সাভিয়ানগর গণহত্যা: ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের এক নৃশংস অধ্যায়

১২

গোয়ালগ্রাম বধ্যভূমি: মুক্তিযুদ্ধের এক ভয়াবহ গণহত্যা (দৌলতপুর, কুষ্টিয়া)

১৩

গুরই গণহত্যা: একটি ঐতিহাসিক ট্র্যাজেডি (নিকলী, কিশোরগঞ্জ)

১৪

৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: কলকাতা মিশন হলো বাংলাদেশ হাইকমিশন

১৫

৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: ইকরদিয়া গণহত্যা – এক নির্মম অধ্যায়

১৬

৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ অভিযান, বিভিন্ন সেক্টরে আক্রমণ

১৭

২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনের প্রতিশ্রুতি

১৮

রাণীগঞ্জ বাজার গণহত্যা | জগন্নাথপুর, সুনামগঞ্জ

১৯

ধোবাজোড়া গণহত্যা | মিটামইন, কিশোরগঞ্জ

২০