১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল স্বাধীনতার জন্য একটি অভূতপূর্ব সংগ্রাম, যেখানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নৃশংসতা এবং গণহত্যার ঘটনাগুলো ইতিহাসের পাতায় চিরকালের জন্য অমর হয়ে আছে। এরকম একটি ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছিল কুমিল্লা জেলার আদর্শ সদর উপজেলায় অবস্থিত কৃষ্ণপুর এবং ধনঞ্জয় গ্রামে। ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ তারিখে সংঘটিত এই গণহত্যায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে শতাধিক নিরীহ নারী, পুরুষ এবং শিশু শহীদ হয়েছিলেন। এই ঘটনা শুধুমাত্র প্রতিশোধের একটি উদাহরণ নয়, বরং মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসিকতা এবং সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের একটি প্রতিচ্ছবি। এই প্রতিবেদনে আমরা এই ঘটনার পটভূমি, ঘটনাপ্রবাহ, শহীদদের পরিচয় এবং উত্তরকালীন প্রভাব বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব, যাতে মূল তথ্যগুলো অক্ষুণ্ণ রাখা হয় এবং ইতিহাসের এই অন্ধকার অধ্যায়টি নতুন প্রজন্মের কাছে স্পষ্টভাবে উপস্থাপিত হয়।
পটভূমি: যুদ্ধের প্রাক্কাল
কৃষ্ণপুর এবং ধনঞ্জয় গ্রামগুলো কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার পাঁচথুবি ইউনিয়নের অন্তর্গত, যা ভারতীয় সীমান্তের সংলগ্ন এলাকায় অবস্থিত। এই অঞ্চলটি মুক্তিযুদ্ধের সময় সামরিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কারণ এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের সক্রিয়তা ছিল উল্লেখযোগ্য। ১০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ তারিখে এই দুটি গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মধ্যে দিনব্যাপী তীব্র যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়, যার ফলে তাদের মধ্যে প্রতিশোধের আগুন জ্বলে ওঠে। মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজার অজুহাতে তারা পরদিন অর্থাৎ ১১ সেপ্টেম্বর পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে আক্রমণ চালায়। এই প্রতিশোধমূলক অভিযানটি শুধুমাত্র যুদ্ধের একটি অংশ নয়, বরং নিরীহ গ্রামবাসীদের উপর নির্মম নির্যাতনের একটি উদাহরণ।
ঘটনাপ্রবাহ: নৃশংসতার বিবরণ
১১ সেপ্টেম্বর সকাল থেকেই আমড়াতলি ইউনিয়নের সর্বত্র প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়। এই গুলির আওয়াজে আতঙ্কিত হয়ে এলাকাবাসীর অনেকে কৃষ্ণপুর, ধনঞ্জয় এবং শিবের বাজার হয়ে পার্শ্ববর্তী বড়জ্বালা সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়ে যান। মাঝিগাছা গ্রামের নারী-পুরুষরাও এই পথে ভারতের দিকে যাত্রা করে। এছাড়া শতশত লোক জীবন বাঁচানোর জন্য এলাপাতাড়ি দৌড়াদৌড়ি করে। এই আতঙ্কের মধ্যে একদল লোক খন্দকার বাড়িতে আশ্রয় নেয়ার জন্য বাড়ির উঠানে জড়ো হয়। খন্দকার সামছুল হুদা তাদের দক্ষিণ ভিটার একটি ঘরে ঢোকান এবং বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দেন, যাতে তারা নিরাপদ থাকেন বলে ভাবেন। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনী প্রথমে খন্দকার সামছুল হুদাকে গুলি করে হত্যা করে, এবং পরে আশ্রয়গ্রহণকারী লোকজনকে নির্মমভাবে গুলি করে। নিহতদের মধ্যে নারী, পুরুষ এবং শিশু ছিল, এবং তাদের মধ্যে নোয়াখালী অঞ্চলের বেশ কয়েকজন ক্ষেতমজুরও অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই একটি বাড়িতেই ২০ জনের অধিক মানুষ গণহত্যার শিকার হন।
এরপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ধনঞ্জয় গ্রামের খন্দকার বাড়ি ঘিরে ফেলে। তারা এখানে ৮ জন মানুষকে হত্যা করে। মনতাজ আলী নামে একজন কাঠের আলমারিতে লুকিয়ে পড়েন, কিন্তু পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে আলমারির ভেতরেই তিনি শহীদ হন। এই নৃশংসতার একটি হৃদয়বিদারক দৃশ্য ছিল: হানাদারদের ব্রাশফায়ারে শহীদ একজন মহিলার স্তনে মুখ দেয়া অবস্থায় একটি শিশু পড়ে থাকে, এবং সেই শিশুটিও গুলিতে শহীদ হয়। এরপর বাড়ির বিভিন্ন স্থানে আরও ১০ জনকে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী। এই দিনের নির্যাতন শুধুমাত্র এখানেই থেমে থাকেনি; পরদিন অর্থাৎ ১২ সেপ্টেম্বর নিকটবর্তী মধ্যম মাঝিগাছা এবং ইটাল্লা গ্রামের ৬ জন নিরপরাধ গ্রামবাসীকে হত্যা করে তারা।
এছাড়া, পাকিস্তানি হানাদাররা গ্রামের ১৪-১৫টি ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়, যার ফলে গ্রামবাসীদের সম্পত্তি এবং জীবিকা ধ্বংস হয়ে যায়। এই আগুনের লেলিহান শিখা গ্রামের আকাশকে কালো করে তুলেছিল, এবং এটি শুধুমাত্র শারীরিক ক্ষতি নয়, বরং মানসিক আঘাতেরও কারণ হয়ে দাঁড়ায়। গণহত্যার খবর পেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ১৫-১৬ জন সদস্য এবং খন্দকার বাড়ির ডা. আবদুল খালেকসহ ৬-৭ জন স্থানীয় ব্যক্তি সন্ধ্যায় খন্দকার বাড়িতে আসেন। তারা বাড়ির সামনে একটি গর্ত খুড়ে এক পাশে পুরুষদের এবং অন্য পাশে নারী ও শিশুদের কবর দেন। এই কবর দেওয়ার দৃশ্যটি মুক্তিযুদ্ধের সাহস এবং সংহতির একটি প্রতীক।
শহীদদের সংখ্যা এবং পরিচয়
কৃষ্ণপুর-ধনঞ্জয় গণহত্যায় মোট শতাধিক মানুষ শহীদ হন, যা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যা। এদের মধ্যে ৩৩ জনের পরিচয় সুনির্দিষ্টভাবে জানা গেছে। তাদের নামগুলো নিম্নরূপ:
এই শহীদরা শুধুমাত্র সংখ্যা নয়, তারা ছিলেন সাধারণ গ্রামবাসী, কৃষক, মজুর এবং পরিবারের সদস্য, যাদের জীবন স্বাধীনতার সংগ্রামে বলিদান হয়েছে।
উত্তরকাল: স্মৃতি এবং প্রভাব
এই গণহত্যার পর এলাকায় একটি গভীর শোকের ছায়া নেমে আসে। শহীদদের স্মরণে কৃষ্ণপুর-ধনঞ্জয় এলাকায় একটি স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপিত হয়েছে, যা আজও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি জাগিয়ে রাখে। এই স্মৃতিস্তম্ভটি শুধুমাত্র একটি স্থাপত্য নয়, বরং স্বাধীনতার মূল্যবোধ এবং শহীদদের ত্যাগের প্রতীক। এই ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের অন্যান্য গণহত্যার মতোই বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত, যা আজও আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে স্বাধীনতা কতটা মূল্যবান এবং কতটা রক্তের বিনিময়ে অর্জিত।
সূত্র:
বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড [শফিউদ্দিন তালুকদার ও মামুন সিদ্দিকী]
মন্তব্য করুন