১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী এবং তাদের স্থানীয় সহযোগী রাজাকারদের দ্বারা সংঘটিত অসংখ্য গণহত্যা এবং অত্যাচারের ঘটনা দেশের ইতিহাসে চিরকালীন কলঙ্ক হিসেবে রয়ে গেছে। এরকম একটি নির্মম ঘটনা হলো ঘোড়াইল গণহত্যা, যা নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া থানার অধীনে ঘটেছিল। এই গণহত্যা সংঘটিত হয় ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সালে, যাতে ৩ জন সাধারণ নিরীহ মানুষ নিহত হন। এই ঘটনা শুধুমাত্র একটি গ্রামের বাসিন্দাদের উপর অত্যাচারের উদাহরণ নয়, বরং মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে শরণার্থীদের লক্ষ্য করে চালানো লুণ্ঠন এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসার একটি প্রতিফলন। নিম্নে এই ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হলো, যা গ্রামের ভৌগোলিক অবস্থান, পটভূমি, আক্রমণের বিবরণ এবং পরিণতি নিয়ে আলোচনা করে।
গ্রামের ভৌগোলিক অবস্থান এবং সামাজিক প্রেক্ষাপট
ঘোড়াইল গ্রাম নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া থানার মাসকা ইউনিয়নের অধীনে অবস্থিত। এই গ্রাম কেন্দুয়া থানা সদর থেকে মাত্র ১ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত, যা এটিকে শহরের কাছাকাছি একটি শান্ত গ্রাম্য এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করে। গ্রামটিতে হিন্দু এবং মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকজনের মিলিত বসতি ছিল, যা বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের একটি সাধারণ ছবি প্রতিফলিত করে। এখানকার বাসিন্দারা প্রধানত কৃষি এবং ছোটখাটো ব্যবসা-বাণিজ্যের উপর নির্ভরশীল ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর, ১৯৭১ সালের মার্চ মাস থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অত্যাচার এবং গণহত্যার ভয়ে অনেক মানুষ তাদের বাড়িঘর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজতে বাধ্য হন। ঘোড়াইল গ্রাম এমনই একটি আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে। কেন্দুয়া শহর এবং অন্যান্য স্থান থেকে অনেক লোক এখানে এসে আশ্রয় নেন। এই শরণার্থীদের মধ্যে ছিলেন কেন্দুয়া সদরে বসবাসকারী আওয়ামী লীগ নেতা অতুল চন্দ্র সরকার (পিতা: জয়নাথ সরকার), তাঁর পুত্র সন্তোষ সরকার (যিনি বর্তমান নিবন্ধের লেখক) এবং তাঁর পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা। এছাড়া, কেন্দুয়া বাজারের স্বর্ণব্যবসায়ী কুঞ্জ বিহারী পোদ্দার এবং উপেন্দ্র চন্দ্র পোদ্দার, সেইসাথে রুহিণী বণিকের পরিবার-পরিজনরা ঘোড়াইল গ্রামের অনিল চন্দ্র বণিক, ধীরেন্দ্র চক্রবর্তী এবং ধোপাবাড়িসহ অন্যান্য বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এই শরণার্থীরা মূলত হিন্দু সম্প্রদায়ের ছিলেন এবং তাদের কাছে কিছু সম্পদ ছিল, যা পরবর্তীকালে লুণ্ঠনের লক্ষ্যবস্তু হয়ে ওঠে। গ্রামটি শান্ত হলেও, মুক্তিযুদ্ধের উত্তাপ এখানে পৌঁছে যায় এবং এটিকে একটি যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করে।
ঘটনার পটভূমি এবং আক্রমণের কারণ
মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের স্থানীয় সহযোগী রাজাকাররা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের লক্ষ্য করে অভিযান চালাত, সেইসাথে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনকে বিশেষভাবে নির্যাতন করত। ঘোড়াইল গ্রামে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের কাছ থেকে সম্পদ লুণ্ঠন করা এবং আওয়ামী লীগ নেতা অতুল চন্দ্র সরকারকে ধরার উদ্দেশ্যে স্থানীয় দালালদের প্ররোচনায় পাকবাহিনী এই গ্রামে আক্রমণ করে। এই দালালরা পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে যোগসাজশ করে গ্রামের অভ্যন্তরীণ তথ্য সরবরাহ করত, যা আক্রমণের পথ সুগম করে।
অতুল চন্দ্র সরকার পাকবাহিনী এবং রাজাকারদের আক্রমণের আশঙ্কা করে পূর্বেই ঘোড়াইল গ্রাম ছেড়ে একটি নিরাপদ স্থানে চলে যান। এতে করে আক্রমণকারীদের মূল লক্ষ্যবস্তু অর্জিত না হলেও, তারা গ্রামের অন্যান্য নিরীহ বাসিন্দাদের উপর তাদের ক্রোধ প্রকাশ করে। এই পটভূমিতে ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সালে পাকসেনা এবং রাজাকাররা গ্রামে প্রবেশ করে, যা একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পিত অভিযানের রূপ নেয়। এই আক্রমণ শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিহিংসা নয়, বরং অর্থনৈতিক লুণ্ঠনেরও একটি অংশ ছিল, কারণ শরণার্থীদের কাছে থাকা সম্পদ লক্ষ্য করে এটি চালানো হয়।
আক্রমণ এবং গণহত্যার বিবরণ
৫ সেপ্টেম্বর সকালে পাকসেনা এবং রাজাকাররা ঘোড়াইল গ্রামে প্রবেশ করে সরাসরি গ্রামের বণিকবাড়িগুলোতে হানা দেয়। তারা গ্রামের বাসিন্দা রমেশ বণিক (পিতা: ঈশান চন্দ্র বণিক), হরেন্দ্র বণিক (পিতা: হরকিশোর বণিক), অনিল চন্দ্র বণিক (পিতা: হরকিশোর বণিক), ধীরেন্দ্র চক্রবর্তী (পিতা: ঈশান চক্রবর্তী), উপেন্দ্র চন্দ্র পোদ্দার (কেন্দুয়া বাজারের বাসিন্দা), নন্দ কিশোর দে (পিতা: গোবিন্দ চন্দ্র দে, আদমপুরের বাসিন্দা) প্রমুখকে আটক করে। এই লোকজনদের মধ্যে কেউ কেউ স্থানীয় বাসিন্দা ছিলেন, আবার কেউ শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
আটকের পর, পাকসেনা এবং রাজাকাররা তাদের দড়ি দিয়ে বেঁধে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে রাখে এবং তাদের উপর নির্মমভাবে গুলি চালায়। এই গুলিবর্ষণে ঘটনাস্থলেই ৩ জন নিহত হন। হত্যাকাণ্ডের পর, আক্রমণকারীরা গ্রামে ব্যাপক লুণ্ঠন চালায়। তারা বাড়িঘর থেকে সম্পদ, গয়না এবং অন্যান্য মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করে নেয়, যা গ্রামবাসীদের অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত করে। এই লুণ্ঠনের মাধ্যমে পাকবাহিনী এবং রাজাকাররা শুধুমাত্র ভয়ের রাজত্ব কায়েম করেনি, বরং স্থানীয় অর্থনীতিকে ধ্বংস করার চেষ্টা করেছে। গণহত্যার এই ঘটনা গ্রামের শান্ত পরিবেশকে রক্তাক্ত করে তোলে এবং মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে সাধারণ মানুষের ভোগান্তির একটি জ্বলন্ত উদাহরণ হয়ে ওঠে।
পরিণতি এবং স্মৃতিচিহ্ন
ঘোড়াইল গণহত্যার পর, গ্রামবাসীরা গভীর শোক এবং ভয়ের মধ্যে দিন কাটাতে বাধ্য হন। এই ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের অংশ হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পথে একটি বাধা হয়ে দাঁড়ায়, কিন্তু একইসাথে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগ্রামকে আরও তীব্র করে। স্বাধীনতার পর, ৫ সেপ্টেম্বর ঘোড়াইল গ্রামের যে স্থানে এই গণহত্যা চালানো হয়েছিল, সেটিকে চিহ্নিত করে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এই স্থানটি এখন একটি স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে রয়েছে, যা ভবিষ্যত প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের নির্মমতা স্মরণ করিয়ে দেয়। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে গণহত্যার স্থানগুলোর মধ্যে একটি হিসেবে স্থান পেয়েছে, যা শহীদদের স্মৃতিকে জাগরূক রাখে।
ঘোড়াইল গণহত্যা মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে সংঘটিত অসংখ্য অত্যাচারের একটি ছোট্ট অংশ মাত্র, কিন্তু এটি প্রমাণ করে যে, স্বাধীনতার জন্য কতটা রক্ত ঝরাতে হয়েছে। এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশের জনগণ আজও ঐক্যবদ্ধ থেকে অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করে চলেছে।
সূত্র:
বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড
সন্তোষ সরকার
মন্তব্য করুন