১৯৭১ সালের ৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন হিসেবে চিহ্নিত। এই দিনে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের সংগ্রাম নিয়ে বিভিন্ন দেশের নেতা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের মন্তব্য প্রকাশ পায়, যা পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর গণহত্যা এবং অস্ত্র সাহায্যকারীদের দায়িত্ব নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। একই সাথে, ভারতীয় নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশের সমর্থন জানান এবং জাতিসংঘে বিষয়টি উত্থাপনের প্রতিশ্রুতি দেন। অপরদিকে, মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্ধারা বিভিন্ন সেক্টরে সাহসী অভিযান চালিয়ে শত্রুবাহিনীকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এছাড়া, আন্তর্জাতিক সাহায্যকারী সংগঠনের সদস্যদের আটক এবং প্রবাসী বাংলাদেশী প্রতিনিধিদের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা এই দিনের ঘটনাপ্রবাহকে আরও জটিল করে তোলে। নিম্নে এই দিনের বিস্তারিত ঘটনাবলী বর্ণনা করা হলো, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক চাপ এবং যুদ্ধক্ষেত্রের গতিবিধি প্রতিফলিত করে।
আন্তর্জাতিক চাপ এবং অস্ত্র সাহায্যকারীদের দায়িত্ব নিয়ে মন্তব্য
এই দিনে, ভারতে সফররত যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ এবং ভারতে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত অধ্যাপক জন কেনেথ গলব্রেথ কলকাতায় সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন। তিনি স্পষ্টভাবে জানান যে, পূর্ব বাংলায় (বর্তমান বাংলাদেশে) পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী যে ব্যাপক গণহত্যা চালিয়েছে, সে বিষয়ে তাঁর কোনো সন্দেহ নেই। গলব্রেথ আরও জোর দিয়ে বলেন যে, এই গণহত্যা সংঘটিত করতে যারা অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছে, তারাও গণহত্যাকারীদের মতোই সমান অপরাধে দোষী। এই প্রসঙ্গে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন এবং তাঁর সরকারকে সরাসরি অভিযুক্ত করেন, কারণ তারা পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করে এই অপরাধে অংশগ্রহণ করেছে। গলব্রেথের মতে, সমস্যার একমাত্র সমাধান হলো গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুসরণ করে বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। এই মন্তব্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের সংগ্রামকে নতুন মাত্রা যোগ করে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের নীতির সমালোচনা করে।
একইভাবে, ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি হায়দরাবাদে রোটারি ক্লাবের একটি অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দেন। তিনি বাংলাদেশে চলমান ব্যাপক গণহত্যার প্রসঙ্গ উত্থাপন করে বলেন যে, অনেক দেশ এই ঘটনা জেনেও মুখ খুলছে না। এটাকে তিনি অত্যন্ত দুঃখজনক বলে বর্ণনা করেন এবং উল্লেখ করেন যে, বাংলাদেশের এই মর্মন্তুদ ঘটনায় আন্তর্জাতিক সমাজের বিবেক যথেষ্টভাবে জাগ্রত হয়নি। গিরির এই বক্তব্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরও সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানায় এবং বাংলাদেশের সংগ্রামকে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে ধরে। ভারতের কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী ওয়াই বি চ্যাবন জামসেদপুরে একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন। তিনি স্পষ্টভাবে জানান যে, ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন করে যাবে। চ্যাবন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে স্মরণ করিয়ে দেন যে, ভারত এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী এবং যেকোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত ও সক্ষম। এই মন্তব্য ভারতের দৃঢ় অবস্থানকে প্রতিফলিত করে এবং পাকিস্তানকে সতর্ক করে দেয় যে, যুদ্ধের পরিস্থিতিতে ভারত পিছু হটবে না।
ভারতের পররাষ্ট্রসচিব টি এন কাউল কলকাতায় দুই দিনের সফর শেষ করে সাংবাদিকদের বলেন যে, জাতিসংঘের আগামী সাধারণ অধিবেশনে বাংলাদেশের শরণার্থী সমস্যাকে ভালোভাবে তুলে ধরা হবে। তিনি জোর দিয়ে বলেন যে, বাংলাদেশের মানুষের গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক সমাধানই কেবল শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে পারে। কাউলের এই প্রতিশ্রুতি জাতিসংঘের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ানোর দিকে ইঙ্গিত করে এবং শরণার্থী সংকটের রাজনৈতিক সমাধানের উপর গুরুত্বারোপ করে।
প্রবাসী বাংলাদেশী প্রতিনিধিদের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা
সুইডেনে সফররত যুক্তরাজ্য ও বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এই দিন সকালে সুইডেনের সুপ্রিম কোর্টের অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি মিসেস ইনগ্রিড গার্ডেওয়াইডেমার সাথে এবং বিকেলে সুইডিশ পার্লামেন্ট হাউসে লিবারেল পার্টির চিফ হুইপ ইয়ান স্টিফেনসনের সাথে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে আলোচনা করেন। ইয়ান স্টিফেনসন আশ্বাস দেন যে, লিবারেল পার্টি বাংলাদেশকে সমর্থন করবে। এছাড়া, আবু সাঈদ চৌধুরী সুইডেনের খ্যাতনামা সাংবাদিক এবং এক্সপ্রেসেন ইভনিং ডেইলি পত্রিকার সম্পাদক টমাস হ্যামানবার্গের সাথেও সাক্ষাৎ করেন। হ্যামানবার্গও বাংলাদেশের আন্দোলনকে সমর্থন করবেন বলে আশ্বাস দেন। এই আলোচনাগুলো ইউরোপীয় দেশগুলোতে বাংলাদেশের সংগ্রামের প্রতি সমর্থন বাড়ানোর প্রচেষ্টা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ।
দিল্লিতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি কে এম শেহাবউদ্দিন দিল্লি প্রেসক্লাবে সাংবাদিকদের বলেন যে, স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশ কমনওয়েলথে যোগ দিতে চাইবে। তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, বাংলাদেশের একটা বিরাট অংশ এখন মুক্তিবাহিনীর হাতে রয়েছে এবং পুরো স্বাধীনতা অর্জনের প্রশ্ন এখন শুধু সময়ের ব্যাপার। এই মন্তব্য বাংলাদেশের স্বাধীনতার অনিবার্যতা তুলে ধরে এবং আন্তর্জাতিক সংগঠনে যোগদানের পরিকল্পনা প্রকাশ করে।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব মাহবুবুল আলম চাষী এই দিন দিল্লিতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারক কমিটির চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ বিষয়ে বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত ডি পি ধরের সাথে দেখা করেন। তাঁর সাথে তিনি অবিলম্বে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের আগামী অধিবেশনে বাংলাদেশ থেকে প্রতিনিধিদল পাঠানোর বিষয়ে কথা বলেন। ডি পি ধরের সাথে দেখা করার আগে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সাথেও তিনি এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। তবে, মাহবুবুল আলম চাষীর এই অযাচিত দিল্লি সফর ভারতের নীতিনির্ধারণী মহলে যথেষ্ট সন্দেহের উদ্রেক করে। কারণ, ইতিমধ্যে ভারতের গোয়েন্দারা জেনে ফেলেছিল যে, খন্দকার মোশতাক আহমদ, চাষী এবং তাঁদের আরও কয়েকজন সহযোগী বাংলাদেশ সরকারের অগোচরে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে নিয়মিত সংযোগ রক্ষা করে চলেছেন। অন্যদিকে, খন্দকার মোশতাক সরকারকে না জানিয়ে তাঁকে দিল্লি পাঠিয়েছেন। এই ঘটনা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ কূটনৈতিক জটিলতা প্রকাশ করে।
ওমেগা সদস্যদের আটক এবং প্রতিবাদ
ঢাকায় নিয়োজিত যুক্তরাজ্যের ডেপুটি হাইকমিশনারের সূত্রে এই দিন জানা যায় যে, অপারেশন ওমেগার চার সদস্যকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আটক করেছে। তাঁরা যশোর জেলে বন্দী রয়েছেন। ৫ সেপ্টেম্বর তাঁরা ভারতের পেট্রাপোল দিয়ে অবরুদ্ধ বাংলাদেশে ঢোকেন। অপারেশন ওমেগা দলের সংগঠক রজার সোদি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতায় সাংবাদিকদের জানান যে, যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাঁদের কাছে পাঠানো বার্তায় জানিয়েছে, অনধিকার প্রবেশের অভিযোগে ওমেগা দলের চার সদস্যের বিচার হবে। তিনি আরও বলেন যে, ওমেগা দলের সদস্যদের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে অপারেশন ওমেগার সমর্থকেরা লন্ডনে পাকিস্তান হাইকমিশনের সামনে ৯ সেপ্টেম্বর বিক্ষোভ করবেন। যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের পাকিস্তানি দূতাবাসের সামনেও বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হবে। এই ঘটনা আন্তর্জাতিক সাহায্যকারীদের ঝুঁকি এবং প্রতিবাদের মাধ্যমে বাংলাদেশের সংগ্রামকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়।
গেরিলা অভিযান এবং যুদ্ধক্ষেত্রের গতিবিধি
যুদ্ধক্ষেত্রে এই দিন মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্ধারা বিভিন্ন সেক্টরে সক্রিয় ছিলেন। ১ নম্বর সেক্টরে গেরিলা যোদ্ধারা চট্টগ্রামে আদালত ভবনে অভিযান পরিচালনা করেন। এই অভিযান চট্টগ্রাম শহরে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। বার্তা সংস্থা রয়টার্স এই অভিযানের খবর প্রচার করে, যাতে বলা হয় যে, চট্টগ্রামে আদালত ভবনের তিনতলায় একটি টাইমবোমার বিস্ফোরণে কয়েকজন হতাহত হয় এবং তিনজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। এই অভিযান পাকিস্তানি বাহিনীর নিয়ন্ত্রিত এলাকায় মুক্তিবাহিনীর সাহসী উপস্থিতি প্রমাণ করে। ২ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা কুমিল্লার সেনেরহাটে পাকিস্তানি সেনাদের সাথে মুখোমুখি লড়াই করেন। পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিবাহিনীর সেনেরহাট অবস্থানের ওপর তীব্র আক্রমণ করলে মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা আক্রমণ চালান। সারা দিন ব্যাপক যুদ্ধ হয়, যাতে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। মুক্তিবাহিনীর কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাও শহীদ ও আহত হন। এই যুদ্ধ মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধ ক্ষমতা প্রদর্শন করে।
৮ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধাদের তিনটি দল যশোরের সদর থানায় পাকিস্তানি বাহিনীর বারিনগর ক্যাম্প আক্রমণ করে। এতে বেশ কয়েকজন রাজাকার হতাহত হয়। এই অভিযান স্থানীয় সহযোগীদের লক্ষ্য করে মুক্তিবাহিনীর কৌশলগত সাফল্য দেখায়।
মুক্তিবাহিনীর হেডকোয়ার্টারের গণসংযোগ বিভাগের যুদ্ধ বুলেটিনে বলা হয় যে, বিভিন্ন সেক্টরের যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী এই দিন ১১৯ জন শত্রুসেনাকে হত্যা করেছে। এই পরিসংখ্যান মুক্তিবাহিনীর সামগ্রিক সাফল্য এবং যুদ্ধের তীব্রতা তুলে ধরে।
এই দিনের ঘটনাবলী বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, যা আন্তর্জাতিক সমর্থন, কূটনৈতিক চাপ এবং যুদ্ধক্ষেত্রের সাহসী অভিযানের সমন্বয় প্রতিফলিত করে।
সূত্র:
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ছয় ও আট;
মূলধারা ’৭১, মঈদুল হাসান, ইউপিএল, ঢাকা;
স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রবাসী বাঙালি, আবদুল মতিন, র্যাডিক্যাল এশিয়া পাবলিকসেন্স, লন্ডন;
পূর্বদেশ, ঢাকা, ৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১;
আনন্দবাজার পত্রিকা ও যুগান্তর, কলকাতা, ভারত, ৯, ১০ ও ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৭১।
মন্তব্য করুন