বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কালে, যা ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত চলেছিল, অসংখ্য গণহত্যা এবং নৃশংসতার ঘটনা ঘটেছে যা দেশের ইতিহাসে চিরকালের জন্য কালো অধ্যায় হিসেবে অঙ্কিত। এর মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো সাভিয়ানগর গণহত্যা, যা কিশোরগঞ্জ জেলার অষ্টগ্রাম উপজেলায় অবস্থিত সাভিয়ানগর গ্রামে সংঘটিত হয়েছে। এই গণহত্যা ১৯৭১ সালের ৫ সেপ্টেম্বর তারিখে ঘটে, যখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী (পাকসেনা) এবং তাদের স্থানীয় সহযোগী আলবদর বাহিনী নিরীহ গ্রামবাসীদের উপর অমানুষিক অত্যাচার চালায়। এই হত্যাকাণ্ডের নেতৃত্বে ছিলেন আলবদর কমান্ডার কে এম আমিনুল ওরফে রজব আলী, যিনি স্থানীয়ভাবে রজব আলী নামে পরিচিত। এই ঘটনায় মোট ২০ জন সাধারণ মানুষ শহীদ হন, যাদের অধিকাংশই ছিলেন নিরপরাধ গ্রামবাসী, আওয়ামী লীগের সমর্থক, মুক্তিযোদ্ধা এবং আনসার ভিডিপি-র সদস্য।
ঘটনার পটভূমি এবং কারণসমূহ
সাভিয়ানগর গণহত্যার পটভূমি ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানি শাসকদের দমনমূলক নীতি। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙালিদের উপর নির্যাতন চালানোর জন্য স্থানীয় রাজাকার, আলবদর এবং অন্যান্য সহযোগী বাহিনীকে ব্যবহার করত। সাভিয়ানগর গ্রামটি কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রামে অবস্থিত, যা মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে আওয়ামী লীগের সমর্থক এবং মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ছিল। গ্রামের খান বাড়ি এবং চৌধুরী বাড়ির লোকেরা বিশেষভাবে লক্ষ্যবস্তু হয়ে ওঠে কারণ তারা আওয়ামী লীগের সক্রিয় সমর্থক ছিলেন। চৌধুরী বাড়িতে ছিলেন ৬ জন আনসার ভিডিপি-র সদস্য এবং ২ জন মুক্তিযোদ্ধা, যারা স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করছিলেন। অন্যদিকে, খান বাড়ির লোকেরা আওয়ামী লীগের প্রতি তাদের সমর্থনের কারণে পাকসেনার নজরে পড়ে।
আলবদর কমান্ডার রজব আলীর পূর্ব আক্রোশ এই হত্যাকাণ্ডের একটি প্রধান কারণ ছিল। তিনি স্থানীয় রাজাকারদের নেতৃত্বে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে গ্রামে নিয়ে আসেন এবং তার ইশারায় গণহত্যা চালানো হয়। রজব আলীকে এই ঘটনার মূল হোতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, কারণ তিনি গ্রামের নির্দিষ্ট বাড়িগুলোকে লক্ষ্য করে হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করেন। এই আক্রোশের পেছনে ছিল রাজনৈতিক প্রতিহিংসা এবং স্বাধীনতা আন্দোলন দমনের উদ্দেশ্য। ফলে, গ্রামের নিরীহ মানুষেরা এই নৃশংসতার শিকার হন।
ঘটনার বিবরণ: এক নৃশংস দিন
১৯৭১ সালের ৫ সেপ্টেম্বর, সকালবেলা অতর্কিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং আলবদর বাহিনী সাভিয়ানগর গ্রামে হানা দেয়। স্থানীয় রাজাকার এবং আলবদর কমান্ডার রজব আলীর নেতৃত্বে এই আক্রমণ চালানো হয়। তারা গ্রামের খান বাড়ি এবং চৌধুরী বাড়ির পুরুষদের ধরে নিয়ে আসে এবং নিমর্মভাবে হত্যা করে। ঘাতকরা গুলি চালিয়ে ২০ জন মানুষকে হত্যা করে, যাদের মধ্যে ছিলেন গ্রামের সাধারণ বাসিন্দা, আওয়ামী লীগ সমর্থক এবং মুক্তিযোদ্ধা। যারা ঘাতকদের ভয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন, তারা কোনোরকমে প্রাণে বেঁচে যান। কিন্তু যারা ধরা পড়েন, তাদের উপর অমানুষিক অত্যাচার চালানো হয়।
এই হত্যাকাণ্ডের একটি বিশেষ নৃশংস দিক ছিল পিতা-পুত্র এবং স্বজনদের সামনে একে অপরকে হত্যা করা। পিতার সামনে পুত্রকে এবং পুত্রের সামনে পিতাকে গুলি করে হত্যা করা হয়, যা মানসিক নির্যাতনের একটি চরম উদাহরণ। এছাড়া, গ্রামের একজন বিখ্যাত ব্যক্তি, যিনি বাজার-সংলগ্ন মন্নাফ ফকিরের মাজারে 'পাগলা' বলে খ্যাত ছিলেন, সেই ধনু ফকিরও এই হত্যাকাণ্ড থেকে রেহাই পাননি। তিনি নিরপরাধ হওয়া সত্ত্বেও ঘাতকদের হাতে প্রাণ হারান। এই ঘটনা গ্রামের মানুষের মনে চিরকালের জন্য আতঙ্কের ছায়া ফেলে দিয়েছে।
হত্যাকাণ্ডের পর শহীদদের লাশগুলো সাভিয়ানগর বাজারে একটি গণকবরে সমাহিত করা হয়। এই গণকবর আজও সেই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সাক্ষ্য বহন করছে এবং মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি হিসেবে স্মরণীয়। এটি গ্রামবাসীদের জন্য একটি পবিত্র স্থান, যা তাদের স্বাধীনতার জন্য দেওয়া বলিদানের প্রতীক।
নিহতদের তালিকা এবং পরিচয়
সাভিয়ানগর গণহত্যায় নিহতদের মধ্যে যাদের পরিচয় জানা গেছে, তারা নিম্নরূপ। এই তালিকা থেকে বোঝা যায় যে নিহতরা ছিলেন গ্রামের সাধারণ পরিবারের সদস্য, যাদের অধিকাংশই খান, চৌধুরী এবং ভূঞা পরিবার থেকে:
এই তালিকায় উল্লিখিত ব্যক্তিরা সকলেই নিরীহ ছিলেন এবং তাদের হত্যা শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিহিংসা এবং স্বাধীনতা আন্দোলন দমনের উদ্দেশ্যে করা হয়েছে।
ঐতিহাসিক গুরুত্ব এবং স্মৃতি
সাভিয়ানগর গণহত্যা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, যা পাকিস্তানি শাসকদের নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরে। এই ঘটনা থেকে বোঝা যায় যে কীভাবে স্থানীয় সহযোগীরা তাদের নিজের দেশবাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছে। আজও এই গণহত্যার স্মৃতি গ্রামবাসীদের মনে জাগরূক, এবং গণকবরটি একটি স্মারক হিসেবে রক্ষিত। এটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য কতটা বলিদান দেওয়া হয়েছে এবং ভবিষ্যতে এমন নৃশংসতা যেন না ঘটে, সেই শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে।
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড
মন্তব্য করুন