১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম, যেখানে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী এবং তাদের স্থানীয় সহযোগী রাজাকারদের হাতে অসংখ্য নিরীহ মানুষ নির্মমভাবে নিহত হয়। এই যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত গণহত্যার ঘটনাগুলো মানবতার ইতিহাসে এক কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এর মধ্যে উদয়পুর গণহত্যা, যা ১০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সালে বাগেরহাটের মোল্লাহাট উপজেলায় সংঘটিত হয়, একটি বিশেষভাবে হৃদয়বিদারক ঘটনা। এই গণহত্যায় ৭ জন নিরীহ মানুষ নিহত হন, যাদের মধ্যে ৬ জনকে রাজাকাররা জবাই করে হত্যা করে। এই প্রতিবেদনে উদয়পুর গণহত্যার বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে।
ঘটনার পটভূমি
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের প্রতিরোধ তীব্র হয়ে উঠেছিল। এই সময়ে অনেকে নিরাপত্তার জন্য ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর উপজেলার মাটিভাঙ্গা ইউনিয়নের মাটিভাঙ্গা কলেজের (তৎকালীন আইউব খান কলেজ) দর্শন বিভাগের অধ্যাপক প্রতুল চন্দ্র কর্মকার এমনই একজন ব্যক্তি ছিলেন। তিনি সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে পরিবার-পরিজনসহ নৌকাযোগে ভারতের উদ্দেশে রওনা হন। প্রতুলের বাড়ি ছিল পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি উপজেলার আমড়াজুড়ি গ্রামে। তিনি তার নববিবাহিত বধূ, আত্মীয়-স্বজন এবং পার্শ্ববর্তী সুন্দরগ্রামের কিছু বাসিন্দা নিয়ে দুটি নৌকায় যাত্রা শুরু করেন। এই দলটিতে মোট ১৬ জন যাত্রী ছিলেন, যাদের মধ্যে নারী, পুরুষ এবং শিশুরা অন্তর্ভুক্ত ছিল।
দলটির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিরা ছিলেন প্রতুলের দুই কাকা মণীন্দ্রনাথ এবং অহীন্দ্রনাথ, সুনীল কর্মকার (সুন্দরগ্রামের বাসিন্দা), সুনীলের শ্যালক কার্তিক (ঝালকাঠি জেলার বাউকাঠি গ্রামের বাসিন্দা) এবং একজন কিশোরী অনুভা। এই দলটি তাদের সঙ্গে প্রচুর নগদ অর্থ এবং স্বর্ণালঙ্কার নিয়ে যাচ্ছিল।
ঘটনার বিবরণ
মধুমতি নদীতে টহলরত রাজাকাররা নৌকা দুটিকে তীরে ভেড়াতে বাধ্য করে। নৌকাগুলো তীরে পৌঁছানোর পর রাজাকাররা প্রথমে দলটির সঙ্গে থাকা সমস্ত নগদ অর্থ এবং স্বর্ণালঙ্কার লুট করে। এরপর তারা সমগ্র দলটিকে প্রথমে রাজাকার ক্যাম্পে এবং পরে মোল্লাহাট থানায় সোপর্দ করে। মোল্লাহাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ছিলেন একজন সিন্ধি পুলিশ ইন্সপেক্টর। এই কর্মকর্তার কুনজর পড়ে দলের কিশোরী সদস্য অনুভার উপর। তিনি প্রস্তাব দেন যে, যদি অনুভাকে তার কাছে বিয়ে দেওয়া হয়, তবে পুরো দলটিকে মুক্তি দেওয়া হবে।
সপ্তাহ খানেকের মধ্যে রাজাকাররা অনুভাকে ওই পুলিশ কর্মকর্তার কোয়ার্টারে তুলে দেয়। শর্ত অনুযায়ী, দলটির জন্য মুক্তির আদেশপত্র (রিলিজ লেটার) তৈরি করা হয়। কিন্তু এই প্রতিশ্রুতি কেবল একটি প্রতারণা ছিল। দলটিকে মুক্তির জন্য মধুমতি নদীর তীরে জড়ো করা হলে মওলানা ওলিউল্লাহর নেতৃত্বে একদল রাজাকার তাদের ঘিরে ফেলে। তারা শিশু ও নারীদের আলাদা করে ফেলে এবং পুরুষ সদস্যদের উপর নির্মম আক্রমণ শুরু করে।
একজন রাজাকার সতীন্দ্রনাথ নামে একজনকে নদীর খুব কাছে নিয়ে যায় এবং তাকে একটি সিগারেট দেয়। সতীন্দ্রনাথ ধূমপান করছিলেন, এমন সময় রাজাকারটি পেছন থেকে তাকে গুলি করে হত্যা করে। এই দৃশ্য দেখে মণীন্দ্রনাথ আত্মরক্ষার জন্য নদীতে ঝাঁপ দেন। রাজাকাররা তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে, কিন্তু তিনি সাঁতরে নদীর ওপারে পৌঁছে প্রাণে রক্ষা পান।
অবশিষ্ট পুরুষ সদস্যদের রাজাকাররা দড়ি দিয়ে বেঁধে মোল্লাহাটের উত্তরে উদয়পুর গরুর হাটের পাশে নিয়ে যায়। সেখানে তারা একে একে প্রতুল চন্দ্র কর্মকার, অহীন্দ্রনাথ কর্মকার, পঙ্কজ কর্মকার, সুশীল কর্মকার, কার্তিক কর্মকার এবং কেশব কর্মকারকে জবাই করে হত্যা করে। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডে ৭ জন নিরীহ মানুষের প্রাণহানি ঘটে।
গণহত্যার প্রভাব ও তাৎপর্য
উদয়পুর গণহত্যা মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকারদের নৃশংসতার একটি চরম উদাহরণ। এই ঘটনা শুধুমাত্র প্রতুল চন্দ্র কর্মকার এবং তার পরিবারের জন্যই নয়, বরং সমগ্র অঞ্চলের মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়। তবে, এই ধরনের ঘটনাগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধকে আরও তীব্র করে তোলে।
মণীন্দ্রনাথের বেঁচে যাওয়া এই ঘটনার একমাত্র জীবিত সাক্ষী হিসেবে ঘটনার বিবরণ তুলে ধরেন, যা পরবর্তীতে ইতিহাসে নথিবদ্ধ হয়।
উদয়পুর গণহত্যা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি বেদনাদায়ক ঘটনা। এটি পাকিস্তানি শাসনের নিষ্ঠুরতা এবং তাদের স্থানীয় সহযোগীদের অমানবিক কার্যকলাপের একটি প্রতিচ্ছবি। এই গণহত্যার শহীদদের স্মৃতি বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে চিরকাল অম্লান থাকবে।
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ, ১ম খণ্ড
মন্তব্য করুন