বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং ঘটনাবহুল দিন হিসেবে চিহ্নিত। এই দিনে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কড়া সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়, ভারতে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের আগমন ঘটে, আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের সমর্থনে আলোচনা চলে এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর সাহসিক প্রতিরোধ যুদ্ধ অব্যাহত থাকে। এই সকল ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের গতিপথকে আরও ত্বরান্বিত করে এবং আন্তর্জাতিক মনোযোগ আকর্ষণ করে। নিম্নে এই দিনের বিভিন্ন ঘটনা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হলো, যা যুদ্ধের রাজনৈতিক, কূটনৈতিক এবং সামরিক দিকগুলোকে প্রতিফলিত করে।
প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য: শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনের প্রতিশ্রুতি
মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এই দিন মুজিবনগরে সাংবাদিকদের সামনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা করেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন যে, বাংলাদেশের বিজয় অর্জিত হওয়ার সাথে সাথে ভারতে আশ্রয় নেওয়া সকল শরণার্থীকে সসম্মানে তাদের নিজ নিজ বাস্তুভিটায় পুনর্বাসিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এই বিষয়ে মন্ত্রিসভায় ইতিমধ্যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী আরও উল্লেখ করেন যে, বাংলাদেশ সরকার খুব ভালোভাবে জানে যে শরণার্থীদের ফেলে আসা সমস্ত সম্পত্তি পাকিস্তানের সামরিক জান্তা দখল করে নিয়েছে। তাই, শত্রুসেনার কবল থেকে মুক্ত হওয়ার সাথে সাথে শরণার্থীরা তাদের ন্যায্য মালিকানা ফিরে পাবেন। এই বক্তব্য শরণার্থীদের মধ্যে আশার সঞ্চার করে এবং মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্যকে আরও স্পষ্ট করে তোলে, যা ছিল স্বাধীনতা অর্জনের পাশাপাশি জনগণের অধিকার পুনরুদ্ধার।
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাক্ষাৎকার: যুদ্ধের হুঁশিয়ারি এবং উদ্বাস্তু সমস্যা
একই দিনে দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের প্যারিস থেকে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারের বিবরণ দেওয়া হয়। দৈনিক লা ফিগারো পত্রিকায় এই সাক্ষাৎকারে ইয়াহিয়া খান কড়া হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন যে, ভারত যদি পাকিস্তানি ভূখণ্ডের কোনো অংশ দখলের চেষ্টা করে, তাহলে পাকিস্তান পুরোপুরি যুদ্ধ করবে। তিনি বিশ্বকে সতর্ক করে বলেন, "ভারত যদি মনে করে থাকে তারা বিনা উস্কানিতে আমাদের ভূখণ্ডের কোনো অংশ দখল করতে পারবে, তাহলে তারা মারাত্মক ভুল করবে। এর অর্থ হবে যুদ্ধ।" এছাড়া, তিনি জানান যে, তিনি এখনও জনগণের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ। সীমান্ত পরিস্থিতি সম্পর্কে বলেন যে, এটি মোটেই শান্ত নয়, কারণ ভারতীয় সেনাদের অনুপ্রবেশ এবং বিদ্রোহীদের উস্কানি অব্যাহত রয়েছে। এই কারণেই উদ্বাস্তুরা তাদের বাড়িঘরে ফিরে আসতে পারছেন না। একটি প্রশ্নের উত্তরে তিনি অভিযোগ করেন যে, ভারতীয়রা উদ্বাস্তুদের রাজনৈতিক পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করছে। পূর্ব পাকিস্তানে অভিযান এলাকা থেকে বিদেশি সাংবাদিকদের সরিয়ে রাখার কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, "আমি তাদের রক্ষা করতে চেয়েছিলাম। এই ধরনের সামরিক অভিযান শুরু হলে তার পরিণাম কী হবে তা কেউ জানে না। আমি একজন সৈনিক হিসেবে কাজ করছি, একজন আয়েশি রাজনীতিবিদ হিসেবে নয়। পরে অবশ্য আমি এজন্য দুঃখ প্রকাশ করেছি। যদি কোনো সাংবাদিক আওয়ামী লীগের হাতে নিহত হতেন, সেটা আমার খুবই কাজে আসত।" এই সাক্ষাৎকার পাকিস্তানের আক্রমণাত্মক অবস্থানকে প্রকাশ করে এবং যুদ্ধের সম্ভাবনাকে আরও তীব্র করে তোলে।
ভারতে ঘটনাবলী: বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাখ্যান এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের আগমন
ভারতে এই দিন কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে যা মুক্তিযুদ্ধের কূটনৈতিক দিককে প্রভাবিত করে। কলকাতায় একটি কূটনৈতিক সূত্র থেকে জানা যায় যে, পাকিস্তানে বন্দি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ডের সাথে দেখা করার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছেন। শেখ মুজিব বেঁচে আছেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ডের মাধ্যমে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তার সাথে সমঝোতায় আসার চেষ্টা করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও ব্যক্তিগত দূত হেনরি কিসিঞ্জার যখন ইসলামাবাদে গিয়েছিলেন, তখন প্রথম ফারল্যান্ড এই প্রস্তাব শেখ মুজিবকে পাঠান। দ্বিতীয়বার একই প্রস্তাব পাঠান চলতি মাসের তৃতীয় সপ্তাহে। কিন্তু শেখ মুজিব স্পষ্টভাবে বলেন, "যাদের অস্ত্রে বাঙালিদের হত্যা করা হচ্ছে, তাদের সঙ্গে কথা বলতে চাই না।" এই প্রত্যাখ্যান বঙ্গবন্ধুর অটুট দৃঢ়তা প্রদর্শন করে।
এছাড়া, এই দিন দিল্লি থেকে কলকাতায় আসে ১৬টি দেশের সামরিক বাহিনীর পর্যবেক্ষক দল। এই পর্যবেক্ষকেরা পশ্চিমবঙ্গের শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শন করবেন এবং শরণার্থীদের অবস্থা স্বচক্ষে পর্যবেক্ষণ করবেন। এই দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ফ্রান্স, কানাডা, ইতালি, পশ্চিম জার্মানি, যুগোস্লাভিয়া, ফিলিপাইন, লেবানন, মিসর, ইরান, ঘানা প্রভৃতি। এই আগমন শরণার্থী সমস্যাকে আন্তর্জাতিক স্তরে তুলে ধরে এবং ভারতের উপর চাপ কমাতে সাহায্য করে।
দিল্লিতে এই দিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে দেখা করেন পশ্চিম জার্মানির বিশেষ দূত এমপি গুয়েনভার রিনসাচি। এই বৈঠকে তিনি বলেন, "পূর্ব বাংলার সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানই একমাত্র পথ। আমাদের সরকার শেখ মুজিবের বিচার সম্পর্কেও ওয়াকিবহাল। জার্মানি চায় শেখ মুজিবের মুক্তি দেওয়া হোক। পশ্চিম জার্মানির চ্যান্সেলর উইলি ব্রান্ট সম্প্রতি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে অনুরোধ জানিয়ে বলেছেন, পরিস্থিতি জটিল হয়ে পড়তে পারে, এমন কোনো কাজ যেন তিনি না করেন।" এই বৈঠক আন্তর্জাতিক চাপের একটি উদাহরণ।
আন্তর্জাতিক মহলে ঘটনা: নরওয়েতে বাংলাদেশের প্রতিনিধির কূটনৈতিক প্রচেষ্টা
আন্তর্জাতিক মহলে এই দিন নরওয়ের অসলোতে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ দূত আবু সাঈদ চৌধুরী দেশটির প্রধান বিচারপতি পিয়ের অল্ডের সাথে বৈঠক করেন। এই বৈঠকে আবু সাঈদ চৌধুরী বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা নিয়ে সবকিছু খুলে বলেন এবং পাকিস্তানের বিষয়ে কড়া পদক্ষেপ নিতে নরওয়ে সরকারের প্রতি অনুরোধ করেন। পিয়ের অল্ড বলেন, নরওয়ে সবসময়ই মানবতা ও জনগণের রায়ের পক্ষে।
এদিন বিকেলে আবু সাঈদ চৌধুরী নরওয়ের পার্লামেন্ট ভবনে গিয়ে পার্লামেন্টের আন্তর্জাতিক কমিটির সদস্যদের সাথে বাংলাদেশ সম্পর্কে নানা বিষয়ে আলোচনা করেন। এরপর তিনি অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের প্রধানের সাথে দেখা করেন। তার সাথে আবু সাঈদ চৌধুরী বাংলাদেশে চলমান পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ঘৃণ্য গণহত্যা ও আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের বিষয়ে জানান। আবু সাঈদ চৌধুরী বলেন, ট্রাইব্যুনালের প্রধান কাজ হবে গণহত্যা সম্পর্কে একটি প্রামাণ্য প্রতিবেদন প্রণয়ন করা। এই কূটনৈতিক প্রচেষ্টা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেওয়ার দিকে অগ্রসর করে।
দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ: মুক্তিবাহিনীর সাহসিক অপারেশন
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এই দিন মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধ যুদ্ধ অব্যাহত থাকে, যা হানাদার বাহিনীর উপর চাপ সৃষ্টি করে। রংপুরের মিঠাপুকুরের শঠিবাড়ি বন্দরে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার হারেস উদ্দিন সরকারের নেতৃত্বে একটি দল হানাদার বাহিনীর শঠিবাড়ি বন্দর ঘাঁটির উপর আক্রমণ চালায়। এসময় মুক্তিযোদ্ধারা হানাদারদের অবস্থানের ৬০০ গজের মধ্যে এগিয়ে এসে আক্রমণ শুরু করে।
কুমিল্লার চালনা বাজারে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নৌকা দিয়ে চারদিকে আগুন জ্বালাতে জ্বালাতে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের দিকে এগিয়ে যায়। এসময় পূর্ব থেকে ওঁত পেতে থাকা মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা হানাদারদের অ্যামবুশের মধ্যে ফেলে তীব্র আক্রমণ চালায়। ফলে হানাদার বাহিনীর তিনটি নৌকা পানিতে ডুবে যায় এবং বহু সৈন্য নিহত হয়। আক্রমণ শেষে হানাদার সেনারা আর্টিলারির সাহায্যে পাল্টা আক্রমণ চালালে মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা আজাহার আলী শহীদ হন।
কুমিল্লার গজারিয়াতে মুক্তিবাহিনীর একটি গেরিলা দল নারায়ণগঞ্জ-দাউদকান্দি সড়কে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অবস্থানের উপর হামলা চালায়। ঘণ্টাব্যাপী যুদ্ধে ৩ জন হানাদার সৈন্য নিহত হয় এবং একজন বন্দি হয়। মুক্তিযোদ্ধারা হানাদারদের ৫টি রাইফেল ও ১৫০ রাউন্ড গুলি দখল করে।
সিলেটে মুক্তিবাহিনীর ৪৫ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল কোনাগ্রাম ও বিয়ানীবাজার এলাকায় অপারেশন চালায়, যাতে ৩ জন রাজাকার নিহত হয়।
বগুড়ার গাবতলির জাতহলিদা গ্রামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মুক্তিবাহিনীর উপর অতর্কিত হামলা চালায়। এসময় মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার সৈয়দ আহসান হাবিব দিপুর নেতৃত্বে একটি দল পাল্টা গুলিবর্ষণ করে, যার ফলে উভয় পক্ষের মধ্যে তীব্র সংঘর্ষ হয়। এতে একজন হানাদার সৈন্য নিহত হয়, কিন্তু পাকিস্তানি সেনারা ৫ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে। এই সকল অপারেশন মুক্তিবাহিনীর সাহস এবং হানাদারদের দুর্বলতা প্রদর্শন করে।
এই দিনের ঘটনাবলী মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পথকে আরও সুনিশ্চিত করে এবং আন্তর্জাতিক সমর্থনকে শক্তিশালী করে।
সূত্র:
-বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র ষষ্ঠ, দশম, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড
- দৈনিক পাকিস্তান, ২ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
- দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা, ৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
মন্তব্য করুন