মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি দিন ছিল একটি যুদ্ধক্ষেত্রের মতো—দেশের অভ্যন্তরে সশস্ত্র সংঘর্ষ, আন্তর্জাতিক কূটনীতি, এবং মানুষের অদম্য সংগ্রামের গল্প। ১৯৭১ সালের ৩ সেপ্টেম্বরও ছিল এমন একটি দিন, যেখানে ভারতীয় নেতৃত্বের দৃঢ়তা, আন্তর্জাতিক সমর্থনের প্রচেষ্টা, পাকিস্তানি প্রশাসনের চালাকি, এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ অভিযানগুলো একসঙ্গে মিলেমিশে একটি জটিল চিত্র তৈরি করেছিল। এই দিনের ঘটনাগুলো শুধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অংশ নয়, বরং বিশ্ব রাজনীতির একটি প্রতিফলনও। বাংলাদেশে চলমান মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে, এই দিনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো, যা দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রচেষ্টা এবং চ্যালেঞ্জগুলোকে প্রকাশ করে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর দৃঢ় বক্তব্য: চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রতিরক্ষা বাহিনীর দায়িত্ব
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এই দিনে দিল্লিতে ভারতীয় বিমানবাহিনীর অধিনায়কদের একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলনে যোগ দেন। এই সম্মেলনটি ছিল ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার একটি অংশ, যা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাথে সরাসরি যুক্ত। তাঁর বক্তৃতায় ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশে চলমান মুক্তিযুদ্ধকে একটি অভূতপূর্ব ঘটনা হিসেবে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, "পৃথিবীর আর কোথাও জনগণ এভাবে সংঘবদ্ধ হতে পারেনি।" এই যুদ্ধের কোনো বিকল্প নজির নেই বলে উল্লেখ করে তিনি ভারতের সামনে থাকা চ্যালেঞ্জগুলোর কথা তুলে ধরেন। একদিকে অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি, যেমন শরণার্থী সংকট এবং অর্থনৈতিক চাপ, অন্যদিকে বহিঃশত্রুর হুমকি—যা স্পষ্টতই পাকিস্তানের দিকে ইঙ্গিত করে। ইন্দিরা গান্ধী জোর দিয়ে বলেন যে, ভারতকে এই দুই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তৈরি থাকতে হবে, এবং দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীকে এই দায়িত্ব বিশেষভাবে নিতে হবে। এই বক্তব্যটি ভারতের সামরিক প্রস্তুতির একটি স্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল, যা পরবর্তীকালে ডিসেম্বরের যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি শুধু ভারতীয় বিমানবাহিনীকে উদ্বুদ্ধ করেনি, বরং আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের সংগ্রামকে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে।
যুক্তরাজ্যের রাজনৈতিক চাপ: শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার বন্ধের প্রচেষ্টা
এই দিনে, ভারত সফররত যুক্তরাজ্যের কনজারভেটিভ পার্টির সাংসদ কেনেথ বেকার পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন। এই পরিদর্শনের পর দিল্লি রওনা হওয়ার আগে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত দেন। তিনি জানান যে, তাঁদের সরকার পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে যাতে শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারের উদ্যোগ বন্ধ হয়। শেখ মুজিব, যিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান নেতা, তখন পাকিস্তানি কারাগারে বন্দী ছিলেন এবং তাঁর বিরুদ্ধে বিচারের প্রক্রিয়া চলছিল। কেনেথ বেকারের এই বক্তব্য যুক্তরাজ্যের অবস্থানকে প্রকাশ করে, যা বাংলাদেশের পক্ষে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ ছিল। এটি আন্তর্জাতিক চাপের একটি উদাহরণ, যা পাকিস্তানের নৃশংসতাকে চ্যালেঞ্জ করছিল এবং মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করছিল।
নেপালের সমর্থন: আন্তর্জাতিক সংস্থায় ভারতের পাশে
কাঠমান্ডুতে এই দিনে নেপালের রাজা মহেন্দ্র বীর বিক্রম শাহ দেব এবং প্রধানমন্ত্রী কীর্তিনিধি বিস্তা ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার সরণ সিংয়ের সাথে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেন। এই আলোচনার সময় তারা জানান যে, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থায় বাংলাদেশের ব্যাপারে নেপাল ভারতকে সমর্থন জানাবে। এই সমর্থনটি ছিল ভারতের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার একটি সাফল্য, যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সংহতি তৈরি করছিল। নেপালের এই অবস্থান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে আঞ্চলিক সমর্থন প্রদান করে, যা পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতাকে আরও গভীর করেছিল।
কাজী নজরুল ইসলামের ছেলের প্রত্যাখ্যান: পাকিস্তানের ভাতা প্রস্তাবের বিরুদ্ধে দৃঢ়তা
কবি কাজী নজরুল ইসলামের ছেলে কাজী সব্যসাচী এই দিনে পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে কবির জন্য মাসিক ভাতা দেওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেন, "লাখ লাখ মানুষের রক্তমাখা টাকা তিনি স্পর্শ করবেন না।" পাকিস্তান আগে কবিকে ভাতা দেওয়া বন্ধ করেছিল, কিন্তু বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি কবিকে ভাতা দেওয়ার ঘোষণা দিলে পাকিস্তান আবার নতুন করে ভাতা দেওয়ার প্রস্তাব করে। কাজী সব্যসাচী দিল্লিতে একটি বিবৃতিতে এই প্রস্তাবকে পাকিস্তানের ঔদ্ধত্য হিসেবে বর্ণনা করেন। এই ঘটনাটি কবির পরিবারের নৈতিক দৃঢ়তাকে প্রকাশ করে, যা মুক্তিযুদ্ধের মানসিক যুদ্ধের একটি অংশ ছিল।
প্যারিসে আন্তসংসদীয় সম্মেলন: বাংলাদেশের বিষয় আলোচ্যসূচি থেকে বাদ
প্যারিসে চলমান আন্তসংসদীয় সম্মেলনে এই দিনে বাংলাদেশের পরিস্থিতি আলোচনার জন্য সদস্যদের ভোটে প্রস্তাবটি আলোচ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হয়। ভোটের ফলাফল ছিল ৪৯৮-৭৪, এবং ১৯৫ জন ভোটদানে বিরত থাকেন। প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন ভারতের প্রতিনিধিদলের প্রধান এবং লোকসভার স্পিকার ড. জি এস ধীলন। কিন্তু সম্মেলনের চেয়ারম্যান ফ্রান্সের অ্যাকিলি পেরেসি রায় দেন যে, বিষয়টি স্ট্যান্ডিং অর্ডারের বিধিবহির্ভূত, তাই বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা হবে না। আপত্তি মূলত এসেছিল আরব ও মুসলমান সাংসদদের কাছ থেকে। এই ঘটনাটি আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশের সংগ্রামের চ্যালেঞ্জগুলোকে তুলে ধরে, যেখানে কূটনৈতিক বাধা সত্ত্বেও ভারতের প্রচেষ্টা অব্যাহত ছিল।
আবু সাঈদ চৌধুরীর নরওয়ে সফর: স্ক্যান্ডিনেভিয়ার সমর্থনের আশা
নরওয়ে সফররত যুক্তরাজ্য ও বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এই দিনে অসলোর মেয়রের সাথে দেখা করেন। মেয়র বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থন জানান এবং আবু সাঈদ চৌধুরীকে অসলো শহরের আলোকচিত্র-সংবলিত একটি বই উপহার দেন, যেখানে তাঁকে বাংলাদেশের বিশেষ প্রতিনিধি বলে উল্লেখ করেন। বিকেলে তিনি নরওয়ের পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী স্টলটেনবার্গের সাথে সাক্ষাৎ করেন। স্টলটেনবার্গ জানান যে, স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের আসন্ন সম্মেলনে নরওয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামকে সমর্থন জানিয়ে বিবৃতি পেশ করবে। এই সফরটি বাংলাদেশের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার একটি সাফল্য, যা ইউরোপীয় দেশগুলোর সমর্থন জোগাড় করছিল।
ব্রিটেনের দ্য টাইমস-এ প্রতিবেদন: পাকিস্তানে সাহায্য বন্ধের আহ্বান
ব্রিটেনের দ্য টাইমস পত্রিকা এই দিনে দেশটির সাবেক মন্ত্রী এবং লেবার পার্টির নেতা পিটার ডেভিড শোরের বক্তব্যের ওপর ভিত্তি করে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। পিটার শোর বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানে আবার বাণিজ্যিক বা আর্থিক সাহায্যের সূচনা করা যুক্তরাজ্য সরকারের উচিত হবে না। তিনি জোর দিয়ে বলেন যে, পাকিস্তানের সরকারকে বুঝতে হবে যে পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ভেঙে গেছে, এবং সেখানে ক্ষমতা থেকে তাদের সরে আসতে হবে। যুক্তরাজ্য সরকার এ পর্যন্ত একটি সন্তোষজনক সীমারেখা গ্রহণ করেছে, কিন্তু অক্টোবরে আবার বাণিজ্য সুবিধা শুরু করার ঔচিত্য নিয়ে ভাবতে হবে। এই প্রতিবেদনটি পাকিস্তানের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়িয়েছে।
অবরুদ্ধ বাংলাদেশে নতুন গভর্নরের শপথ এবং রাজনৈতিক মুক্তি
অবরুদ্ধ বাংলাদেশে পাকিস্তানের অনুগত গভর্নর হিসেবে ডা. আবদুল মোত্তালিব মালিক এই দিনে শপথ নেন। শপথবাক্য পাঠ করান বিচারপতি বি এ সিদ্দিকী, এবং অনুষ্ঠানে লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ কে নিয়াজীসহ উচ্চপদস্থ পাকিস্তানি সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এই নিয়োগটি পাকিস্তানের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণকে শক্তিশালী করার চেষ্টা ছিল। একই সাথে, সামরিক কর্তৃপক্ষ পাকিস্তান জাতীয় লীগের সভাপতি আতাউর রহমান খানকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি দেয়। তাঁকে ১৪ জুন ধামরাইয়ের গ্রামের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এই মুক্তিটি পাকিস্তানের রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হতে পারে।
মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ অভিযান: বিভিন্ন সেক্টরে আক্রমণ
মুক্তিযুদ্ধের মাঠপর্যায়ে এই দিনে বিভিন্ন সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধাদের অভিযান চলতে থাকে। ১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা রাতে চট্টগ্রামের নাজিরহাট কলেজে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর ত্রিমুখী আক্রমণ চালান, যাতে একজন পাকিস্তানি সেনা নিহত এবং দুজন আহত হয়। মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় ২ নম্বর সেক্টরের গেরিলা যোদ্ধারা হামলা করলে কয়েকজন সশস্ত্র রাজাকার আত্মসমর্পণ করে। ৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের ভোমরা সীমান্তঘাঁটিতে প্রচণ্ড গুলিবর্ষণ করেন, যাতে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। ভালুকার ভরাডুবা গ্রামে ১১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকারের ওপর হামলা করলে কয়েকজন রাজাকার নিহত হয়। এই অভিযানগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা যুদ্ধের কৌশলকে প্রকাশ করে, যা পাকিস্তানি বাহিনীকে দুর্বল করে দিচ্ছিল।
এই দিনের ঘটনাগুলো মুক্তিযুদ্ধের বহুমুখী চরিত্রকে তুলে ধরে—কূটনীতি, রাজনীতি, এবং সশস্ত্র সংঘর্ষের মিশ্রণ। এগুলো শেষ পর্যন্ত ডিসেম্বরের বিজয়ের পথ প্রশস্ত করেছে।
সূত্র:
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর এক, দুই, সাত, আট ও এগারো;
স্বাধীনতাসংগ্রামে প্রবাসী বাঙালি, আবদুল মতিন, র্যাডিক্যাল এশিয়া পাবলিকেশনস, লন্ডন;
দ্য টেলিগ্রাফ ও দ্য টাইমস, লন্ডন, ৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১;
দৈনিক পাকিস্তান, ৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১;
আনন্দবাজার পত্রিকা, ভারত, ৪ ও ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১।
মন্তব্য করুন