বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আত্মা ও অস্তিত্বের ভিত্তি হলো ১৯৭২ সালের সংবিধানের চার মূলনীতি - জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এই চার মূলনীতি কাগজে লেখা কিছু শব্দ নয় - এটি রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত আমাদের জাতির চুক্তি, আমাদের পথচলার আদর্শিক মানচিত্র। এই মূলনীতিকে বাতিল করার কোনো চক্রান্ত, কোনো চাপ, কিংবা কোনো 'নাগরিক মুখোশ' কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
এনসিপি (কিংস পার্টি) নামের একটি তথাকথিত রাজনৈতিক দল ৭২-এর সংবিধানের চার মূলনীতি বাতিলের দাবি জানিয়েছে। বাস্তবে এই এনসিপি হলো একটি 'কিংস পার্টি' - শাসকগোষ্ঠীর ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা সুবিধাবাদী একটি রাজনৈতিক প্রকল্প, যার লক্ষ্য হলো রাজনীতির নামে বিভ্রান্তি তৈরি, সংবিধানকে দুর্বল করা এবং দেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করা।
এনসিপির মুখপাত্র হিসেবে আজ যিনি সামনে এসেছেন, তিনি হলেন তাসনিম জারা - ইউটিউবে স্বাস্থ্য সচেতনতার কথা বলে পরিচিত হলেও, রাজনৈতিকভাবে তিনি মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজনীতির উত্তরাধিকার বহন করছেন। তিনি রাজাকার সৈয়দ মহিবুল হাসানের নাতনি - যিনি স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় পাকিস্তানপন্থী রাজনীতির সক্রিয় মুখ ছিলেন।
তাসনিম জারা আজ এই চার মূলনীতি বাতিলের কথা বলে তাঁর পারিবারিক উত্তরাধিকারকেই রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন। এটি নিছক ভুল মত নয়, এটি নব্য-রাজাকারতন্ত্রের পুনর্জাগরণের প্রয়াস।
আমরা জানি, ৭২-এর মূলনীতি বাতিলের দাবিতে যে গোষ্ঠী সক্রিয়, তারা শুধুমাত্র আদর্শবিচ্যুত নয়, তারা ইতিহাসবিচ্যুত। তাদের গোপন অভিভাবকত্বে রয়েছে শাসকগোষ্ঠীর সুবিধা, করপোরেট পৃষ্ঠপোষকতা, স্বাধীনতা বিরোধীদের মদদপুষ্ট এবং রাজনৈতিক সুযোগসন্ধান।
NCP কোনো নাগরিক দল নয় - এটি ক্ষমতার ছত্রছায়ায় তৈরি হওয়া এক ধরনের "কিংস পার্টি", যাদের কোনো গণভিত্তি নেই, ইতিহাসের সঙ্গে নেই কোনো সম্পর্ক, বরং তাদের দায়িত্ব হচ্ছে বর্তমান রাজনীতিকে 'ভিন্ন কণ্ঠের' নামে বিভ্রান্ত করা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে খণ্ডিত করা।
বাংলাদেশের জনগণ, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে সচেতন থাকতে হবে - যারা আজ “চার মূলনীতি বাতি” -এর কথা বলে, তারা আগামীকাল ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র, সামরিক দমননীতি বা ‘জাতিরাষ্ট্রের ধারণা’ বিলুপ্ত করার কথাও বলতে পারে।
এই চার মূলনীতি শুধু সংবিধানের বিষয় নয় - এটি আমাদের আত্মপরিচয়ের ভিত্তি। বাংলাদেশ যদি ধর্মনিরপেক্ষ না হয়, যদি সমাজতান্ত্রিক ন্যায়বিচার না থাকে, যদি গণতন্ত্র না থাকে, যদি জাতিরাষ্ট্রের নিজস্ব ভিত্তি দুর্বল হয় - তবে এই দেশ কার? কেন আমরা যুদ্ধ করেছিলাম?
তাই আজ শুধু রাজনৈতিক দল নয় - সাধারণ নাগরিক, সাংস্কৃতিক কর্মী, ছাত্রসমাজ, এবং গণতান্ত্রিক শক্তির উচিত, এইসব প্রতিক্রিয়াশীল অপচেষ্টা ও নব্য রাজাকারের নতুন রূপের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া। তাদের থামাতে হবে এখনই।
এনসিপির মতো কিংস পার্টি আর তাসনিম জারার মতো মুখোশধারী "সোশ্যাল মিডিয়া নেতা"-দের রাজনীতি থেকে আলাদা করে চেনা জরুরি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ৭২-এর সংবিধান রক্ষার লড়াই আজো চলছে - এবং তা নতুন রূপে।
তাই বলছি--
৭২-এর সংবিধান নিয়ে কোনো আপস নয়।
চার মূলনীতি বাতিল নয় - জাতীয় ঐক্যে প্রতিষ্ঠা করো।
তাসনিম জারা ও এনসিপি নয় - জনগণের পক্ষেই হবে রাজনীতি।
রাজাকারদের উত্তরাধিকার নয় - মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তে লেখা ইতিহাসই আমাদের ভবিষ্যৎ।
রুখে দাঁড়াও, প্রশ্ন করো, মুখোশ খুলো - এখনই সময়।
লেখক: সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন
মন্তব্য করুন