ইরানের জাতীয়তাবাদী নেতা মোহাম্মদ মোসাদ্দেককে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল ইংল্যান্ড ও আমেরিকা। তেলক্ষেত্র বাজেয়াপ্ত করার মূল্য দিতে হয়েছিল তাঁকে। অপারেশন অ্যাজাক্স নামে মার্কিনীরা লাখ খানেক ডলারের বিনিময়ে তাঁকে উচ্ছেদ করে।
মোসাদ্দেক উচ্ছেদে যোগ দেয়া ইরানের নাগরিকরা ঠিকই ২৬ বছর পর তার মূল্য চুকিয়েছিলেন। যে রঙিন স্বপ্ন নিয়ে তারা মোহাম্মদ মোসাদ্দেককে উচ্ছেদ করেছিল, তা ফিকে হয়ে যেতে সময় লাগেনি।
মোসাদ্দেক উচ্ছেদ পরবর্তী ইরানে একচ্ছত্র ক্ষমতার মালিক শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভী ২৬ বছর পর ক্ষমতাচ্যুত হন মৌলবাদীদের হাতে। তাঁকে উচ্ছেদ করতে ডান-বাম-মধ্যপন্থী ও মৌলবাদ একত্রিত হয়েছিল, যার প্রধান নেতৃত্ব ছিল মৌলবাদীদের হাতে।
মোসাদ্দেক উচ্ছেদে অংশ নেয়া তরুণরা ২৬ বছর পর জীবনের পড়ন্ত বেলায় নিজেদের আরও বেশি কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের মুখোমুখি হয়েছিল। যে সমস্ত তরুণরা ইরানের শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভী উচ্ছেদে সক্রিয় ছিল, তারা সবাই ২৬ বছর আগে মোসাদ্দেক উচ্ছেদে যুক্ত তরুণদেরই ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারী ও সন্তান ছিল।
এখন জীবনের পড়ন্ত বেলায় এই তরুণরা দেখছে, দেশটি কর্তৃত্ববাদী ও ধর্মতান্ত্রিক স্বৈরাচারের কবলে পড়ে বোমার আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। যে আশায় তারা শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভীকে উচ্ছেদ করেছিল, সে স্বপ্ন মৌলবাদীরা খেয়ে ফেলেছিল। তুদেহ পার্টি করা যে তরুণ সাম্য ও সমাজতন্ত্রের স্বপ্নে আন্দোলনে নেমেছিল, তাকে ড্রাগ ডিলারের তকমা নিয়ে খুন হতে হয়েছিল। ধর্মীয় শাসন শেষ পর্যন্ত মেয়েদের চুল ঢাকার ধর্মতান্ত্রিক প্রয়োগের কুৎসিত রূপে হাজির হয়েছিল। হাজার-হাজার মেয়ে ধর্মতান্ত্রিক পুলিশের হাতে নির্যাতিত ও মৃত্যুবরণ করেছে।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও জায়নবাদ ইরানের গলা চেপে ধরেছে আন্তর্জাতিক আইনের ধার না ধরে। শক্তিমানরা কোন কালেই আইন-কানুনের ধার ধারেনি।
ইরানের নাগরিকরাও বিপ্লব ও ক্ষমতায়নের অবিমৃষ্যকারিতায় এখন হতচকিত!
এখনকার বাংলাদেশে যেমন ক্ষমতার বলয়ে থাকা বলীয়ানরা আইনের ধার ধারছে না। অতীতেও অনেকে ক্ষমতার দম্ভে আইন মানেনি বটে।
রাজনীতির গোলকধাঁধায় রঙিন স্বপ্নে বিভোর নাগরিকরা সাম্রাজ্যবাদের ফড়িয়াদের খপ্পরে আটকে যায়। ইরানের নাগরিকরাও সেই খপ্পরেই আটকে গিয়ে মাতমে মেতেছিল। এর জন্য মূল্য চুকাতে হয়। ইরানীরা মূল্য চুকাচ্ছে ধর্মতান্ত্রিক কর্তৃত্ববাদী শাসণের খপ্পরে পড়ে।
বাংলাদেশেও সাম্রাজ্যবাদ রেজিম চেঞ্জ ঘটিয়েছে স্বপ্নে পরিবর্তনের মাকাল ফল দেখিয়ে। মার্কিন অ্যাক্টিভিস্টরা স্বপ্ন ফেরি করেছে, বাইনারি তৈরি করেছে। কিন্তু গোপন রেখেছে রাজনৈতিক পালাবদলের ক্ষমতায়নের নাটাই ও সুতো কার কাছে থাকবে? দিনশেষে ক্ষমতা দিয়েছে ৭১'র পরাজিত মৌলবাদী শক্তির কাছে। যার পেছনে রয়েছে সেনাবাহিনী।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ প্রযোজিত ডলারোভ্যুত্থান দেশটিকে ভূ-রাজনৈতিক রাজনীতির মৃগয়াক্ষেত্র বানাতে চাইছে। সাম্রাজ্যবাদের সহযোগী মার্কিন অ্যাক্টিভিস্টরা ও বাছালরা (বামে দীক্ষিত কিন্তু ছাগলাদর্শে বিশ্বাসী) সংস্কার-সংস্কার বলে চেঁচিয়ে দেশটির অভ্যন্তরীণ শক্তি ও রাজনৈতিক সমঝোতা ধ্বংস করার মিশনে নেমেছে।
দেশের অর্থনীতি তলানিতে নেমে যাচ্ছে, বিনিয়োগ নাই, সঙ্কুচিত হচ্ছে অর্থনীতি, কমছে জিডিপি, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বেকারত্ব। সাথে বাড়ছে শ্রমিক ছাঁটাই, কমছে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন, কমছে রাজস্ব আয়।
দালাল সরকারটি ক্ষমতায় বসার আনন্দে ও কৃতজ্ঞতায় বন্দর উপঢৌকন দিতে চাচ্ছে সাম্রাজ্যবাদকে!
রাজনীতির ক্ষমতায়নে অংশ নেয়া কোনো অ্যাডভেঞ্চারিজম না। চাইলেই তা পরে ঠিক করা বা শুধরে নেয়া যাবে। মূল্য চুকাতে হয়।
ইরানীরা মূল্য চুকাচ্ছে-বাংলাদেশও মূল্য চুকাবে তা নিশ্চিত।
বাগাড়ম্বরে রাজনৈতিক অবিমৃষ্যকারিতা উবে যায় না।
সাম্রাজ্যবাদ বিনা ফিকিরে ও ধান্ধায় পিঠে হাত বুলায় না।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাবেক ছাত্রনেতা
তথ্যসূত্র
ইরানের রাজনৈতিক ইতিহাস (১৯৫৩-১৯৭৯)
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান (২০২৩-২০২৪)
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষণ
মন্তব্য করুন