সোভিয়েত ইউনিয়নে তিন বছর রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন শেষ করে ডি পি ধর ২৯ জুন দিল্লিতে ফিরে আসেন। তিনি সাংবাদিকদের জানান, জাতিসংঘে বাংলাদেশ বা শরণার্থী সমস্যা নিয়ে আলোচনা উঠলে সোভিয়েত ইউনিয়ন পূর্ণ সমর্থন দেবে। এই ঘোষণা মুক্তিযুদ্ধের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এদিন দিল্লিতে নব কংগ্রেসের সংসদীয় দলের বৈঠকে বলেন, "বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের কূটনৈতিক তৎপরতা ব্যর্থ হয়নি। আমরা বলিষ্ঠ নীতি অনুসরণ করছি, তবে অনাবশ্যক ঝুঁকি নেব না।" তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বেতার ভাষণকে উদ্ধৃত করে বলেন, "পাকিস্তানের শাসকচক্র জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন। বাংলাদেশের প্রকৃত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান।"
এদিনই জয়প্রকাশ নারায়ণ (ভারতের সর্বোদয় নেতা) একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেন, "বড় রাষ্ট্রগুলোর আশ্বাসের অপেক্ষা না করে ভারতকেই বাংলাদেশের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।"
ব্রিটেনের একটি সংসদীয় প্রতিনিধিদল (আর্থার বটমলি, টবি জেসেল, রেজিল্যান্ড প্রেন্টিস ও জেমস র্যামসডেন) ভারতের শরণার্থী শিবির পরিদর্শনকালে বিক্ষোভের মুখে পড়েন। প্রতিনিধিরা শরণার্থীদের আশ্বাস দেন যে তাদের দাবি পূরণে চেষ্টা করা হবে।
পাকিস্তান টেলিভিশনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তারা বলেন, "পূর্ব পাকিস্তানে ত্রাসের পরিবেশ বিদ্যমান। আমরা গ্রামের পর গ্রাম শূন্য দেখেছি, সড়ক ও রেলসেতু বিধ্বস্ত। হিন্দু নিধনের জ্বলন্ত প্রমাণও রয়েছে।"
ন্যাপপ্রধান মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এক বিবৃতিতে পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের প্রতি ধিক্কার জানিয়ে বলেন, "যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ও অর্থ সাহায্য পাকিস্তানের দখলদার বাহিনীকে শক্তিশালী করছে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের একমাত্র পণ—হয় পূর্ণ স্বাধীনতা, নয়তো মৃত্যু। গোঁজামিলের কোনো স্থান নেই।"
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার নতুন প্রস্তাবের প্রতিবাদে যুক্তরাজ্য ও নিউইয়র্কের বন্দরে কর্মরত বাঙালি নাবিকরা পাকিস্তানি জাহাজ ছেড়ে চলে যান। এটি পাকিস্তানের জন্য একটি বড় ধরনের মনোবলঘাতী ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ক্রিস টাফার ভ্যান হোলেন সিনেটের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপকমিটিকে বলেন, "পাকিস্তানে অস্ত্র পাঠানোর ব্যাপারে নিয়ন্ত্রণ আছে, তবে ২৫ মার্চের আগেই কিছু চুক্তি পাকা হয়েছিল। এখন অস্ত্র চালান বন্ধ করলে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষতি হতে পারে।"
সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি এই যুক্তি মানতে অস্বীকার করে বলেন, "জাহাজি লাইসেন্স বাতিল করেই অস্ত্র চালান বন্ধ করা যায়।" তিনি পাকিস্তানে অস্ত্র বিক্রির বিরুদ্ধে ২৮ জুন পররাষ্ট্র দপ্তরে অভিযোগও পেশ করেন।
এদিনই যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় স্বীকার করে, "নিউইয়র্ক বন্দরে 'কাপ্তাই' নামে একটি মালবাহী জাহাজে অস্ত্র বোঝাই করা হচ্ছে। আগামী মাসে আরও চার-পাঁচটি জাহাজে অস্ত্র পাঠানো হতে পারে।"
ব্রিটিশ সংবাদপত্রগুলো ইয়াহিয়া খানের ভাষণকে নস্যাৎ করে। দ্য গার্ডিয়ান-এর সম্পাদকীয়তে বলা হয়, "ইয়াহিয়ার প্রস্তাব এক ধাপ্পা মাত্র।" দ্য টাইমস লিখে, "এতে বাংলাদেশের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ হবে না।"
কলকাতার বাংলাদেশ মিশনের প্রধান এম হোসেন আলী সাংবাদিকদের বলেন, "বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানের দখলদার বাহিনীকে হটিয়ে দিতে আমরা বদ্ধপরিকর। এজন্যই বাঙালি এতদূর আসতে পেরেছে।"
দৈনিক ইত্তেফাক, ৩০ জুন ১৯৭১
দৈনিক আজাদ, ৩০ জুন ও ১ জুলাই ১৯৭১
আনন্দবাজার পত্রিকা (ভারত), ৩০ জুন ১৯৭১
দৈনিক যুগান্তর (ভারত), ১ জুলাই ১৯৭১
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড)
গার্ডিয়ান ও টাইমস-এর সম্পাদকীয়, ২৯ জুন ১৯৭১
মন্তব্য করুন