পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ২৮ জুন একটি বেতার ভাষণে ঘোষণা দেন যে, শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়েছে। তিনি দাবি করেন, চার মাসের মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে, তবে "পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থা" ফিরে না আসা পর্যন্ত দেশ সামরিক শাসনের অধীনেই থাকবে।
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ: যদিও নির্বাচিত প্রতিনিধিরা ব্যক্তিগতভাবে তাদের পদ ধরে রাখবেন, তবে যারা "রাষ্ট্রবিরোধী কার্যক্রমে" জড়িত তাদের সদস্যপদ বাতিল করা হবে।
উপনির্বাচনের মাধ্যমে শূন্য আসন পূরণ: আওয়ামী লীগের শূন্য আসনগুলোতে নতুন করে নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিনিধি নেওয়া হবে।
সামরিক ছত্রচ্ছায়ায় সরকার: ইয়াহিয়া দাবি করেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসা পর্যন্ত সামরিক বাহিনীর তত্ত্বাবধানে সরকার চলবে।
ইয়াহিয়ার প্রস্তাবের তীব্র নিন্দা করে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার (মুজিবনগর সরকার) এবং আন্তর্জাতিক মহল।
এ এইচ এম কামারুজ্জামান (স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী) বলেন, "ইয়াহিয়া পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রধান। তাঁর বিশেষজ্ঞ কমিটি পশ্চিম পাকিস্তানিদের জন্য সংবিধান তৈরি করবে, পূর্ব বাংলার জনগণের এতে কোনো ভূমিকা নেই।"
মুজিবনগরে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের বৈঠক: তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা দেয় যে, শীঘ্রই নির্বাচিত প্রতিনিধিদের একটি অধিবেশন বসবে। এতে মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতি, বৈদেশিক সাহায্য ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হবে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং লোকসভায় বলেন, "আওয়ামী লীগের কিছু দলত্যাগী সদস্যকে নিয়ে সরকার গঠন করা হলে তা বাংলাদেশের জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতেই ক্ষমতা হস্তান্তরই একমাত্র সমাধান।"
প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বিরোধী দলনেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বলেন, "এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার লড়াই। ভারতের ভূমিকা সহায়কের, কিন্তু মূল লড়াই তাদেরই করতে হবে। অসময়ে স্বীকৃতি দেওয়া যুক্তিযুক্ত নয়।"
পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিডিপি)-এর নুরুল আমিন ইয়াহিয়ার প্রস্তাবকে "জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের ইতিবাচক পদক্ষেপ" বলে অভিহিত করেন।
জামায়াতে ইসলামীর গোলাম আযম বিবৃতিতে বলেন, "ইয়াহিয়ার ঘোষিত কর্মসূচিই জাতির জন্য একমাত্র পথ।"
ঢাকায় একটি সামরিক আদালত ছয় জন ছাত্রনেতাকে ১৪ বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেয়। এরা হলেন:
আ স ম আবদুর রব
আবদুল কুদ্দুস মাখন
নূরে আলম সিদ্দিকী
শাজাহান সিরাজ
মোস্তফা মহসীন মন্টু
খায়রুল ইনাম খসরু
এই রায় দেওয়া হয় অনুপস্থিতিতে, কারণ এ সময় তারা মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছিলেন।
কুমিল্লা: মুক্তিযোদ্ধারা রাজারমার দীঘিতে পাকিস্তানি ক্যাম্পে আক্রমণ করে একটি বাঙ্কার ধ্বংস করে এবং অস্ত্র লুট করে।
মনোহরপুর (কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়ক): মুক্তিবাহিনীর অ্যামবুশে কয়েকজন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। প্রতিশোধ হিসেবে হানাদার বাহিনী মনোহরপুর ও মাগুরা গ্রামে অগ্নিসংযোগ করে।
ভূরুঙ্গামারী (কুড়িগ্রাম): পাকিস্তানি সেনারা ভূরুঙ্গামারী দখল করে নেয়, মুক্তিযোদ্ধারা সোনাহাট সীমান্তে পুনর্গঠিত হয়।
২৮ মে ১৯৭১-এ পাকিস্তানি বাহিনী বরিশালের কলসকাঠি গ্রামে ৮৭ জন হিন্দু ধর্মাবলম্বীকে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে। লাশগুলি নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয় এবং গ্রামটিতে অগ্নিসংযোগ করা হয়।
বাংলাদেশ সফর শেষে টবি জেসেল সাংবাদিকদের বলেন,
"গ্রামে গ্রামে গণহত্যা ও লুণ্ঠন চলছে। স্থানীয়রা পালিয়ে গেছে। আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, শরণার্থীদের ফিরে যাওয়া এখন নিরাপদ নয়।"
হেমডিক ফ্যানডং কুষ্টিয়া সফর শেষে বলেন,
"কুষ্টিয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসস্তূপের মতো। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিমান হামলা ও লুটপাটে শহরটি বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে।"
রিচার্ড নিক্সন (মার্কিন প্রেসিডেন্ট) ইন্দিরা গান্ধীকে চিঠিতে লেখেন, "পূর্ব পাকিস্তানে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে আমরা ইয়াহিয়াকে রাজি করাব। তবে পাকিস্তানের অখণ্ডতা বজায় রাখাই আমাদের লক্ষ্য।"
ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট সুহার্তো ইয়াহিয়াকে সমর্থন জানিয়ে বলেন, "পূর্ব পাকিস্তান ইস্যুতে পাকিস্তানের সিদ্ধান্তকে আমরা শ্রদ্ধা করি।"
দৈনিক ইত্তেফাক, ২৯ ও ৩০ জুন ১৯৭১
দৈনিক আজাদ, ২৯ ও ৩০ জুন ১৯৭১
আনন্দবাজার পত্রিকা (ভারত), ২৯ জুন ও ২ জুলাই ১৯৭১
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র (সপ্তম, অষ্টম, নবম, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড)
দৈনিক পাকিস্তান, ২৯ মে ১৯৭১
দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা, ২৯ মে ১৯৭১
সেক্টরভিত্তিক মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস (সেক্টর ২, ৫ ও ৭)
মন্তব্য করুন