১৯৭১ সালের ২৪ জুন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিন হিসেবে চিহ্নিত। এদিন পাকিস্তানে মার্কিন অস্ত্র সরবরাহের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিবাদ দেখা দেয়। দিল্লিতে মার্কিন দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভকারীরা এক স্মারকলিপি পেশ করে, যাতে বলা হয়, "যুক্তরাষ্ট্র সরকার পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করে বাংলাদেশে গণহত্যা চালানোর সুযোগ করে দিচ্ছে।"
ভারতীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের অবস্থান
প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী লোকসভায় বলেন, "ভারত একটি সংকটময় পরিস্থিতির মুখোমুখি। জাতীয় ঐক্য জোরদার করে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।"
পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং জানান, ভারত সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে পাকিস্তানগামী অস্ত্রবোঝাই জাহাজ থামানোর দাবি জানিয়েছে।
মন্ত্রিসভার রাজনৈতিক কমিটি বাংলাদেশ পরিস্থিতি ও মার্কিন অস্ত্র সরবরাহ নিয়ে জরুরি বৈঠক করে।
শরণার্থী শিবিরে বিক্ষোভ যুক্তরাষ্ট্রের শরণার্থীবিষয়ক বিশেষ সহকারী ফ্রাংক এল কেলাগ পশ্চিমবঙ্গের বয়রা শরণার্থী শিবির পরিদর্শনকালে শরণার্থীদের তীব্র বিক্ষোভের মুখোমুখি হন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান-এর নেতৃত্বে বুদ্ধিজীবীদের পক্ষ থেকে কেলাগকে স্মারকলিপি দেওয়া হয়, যাতে পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধের দাবি জানানো হয়।
যুক্তরাষ্ট্র: পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র চার্লস ব্রে স্বীকার করেন, সুন্দরবন, পদ্মা ও কাউখালী নামে তিনটি জাহাজে অস্ত্র পাকিস্তানে পাঠানো হয়েছে। তবে তিনি দাবি করেন, ২৬ মার্চের পর অস্ত্র সরবরাহের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে।
মেক্সিকো ও শান্তি সংগঠন: সাবেক প্রেসিডেন্ট ফোর্ট জিল ও ড. রিকার্ডো মলিনা মার্টি পাকিস্তানের গণহত্যা বন্ধে বিশ্ব সম্প্রদায়ের হস্তক্ষেপ চান।
ইসরায়েল: পররাষ্ট্রমন্ত্রী আববা ইবান ইসরায়েলের সংসদে বলেন, "শরণার্থীদের সাহায্য করতে ইসরায়েল প্রস্তুত।" এটি বাংলাদেশ ইস্যুতে ইসরায়েলের প্রথম সরকারি বক্তব্য।
ইয়াহিয়া খানের ভাষণ: রাওয়ালপিন্ডি থেকে ঘোষণা করা হয়, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ২৮ জুন জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন।
রাজনৈতিক আলোচনা: জামায়াতে ইসলামীর নেতা মাওলানা মুফতি মাসুদ ও গোলাম আযম, পিপিপি নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠক করেন।
ব্রিটিশ প্রতিনিধিদল: ব্রিটিশ সংসদীয় একটি দল ঢাকায় পৌঁছে সামরিক গভর্নর টিক্কা খান-এর সঙ্গে দেখা করে।
পাকিস্তানি আক্রমণ: ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মন্দভাগে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানে পাকিস্তানি সেনারা ভারী অস্ত্রে আক্রমণ চালায়। দুই ঘণ্টা যুদ্ধের পর তারা পিছু হটে।
মুক্তিবাহিনীর অভিযান
কুমিল্লার বিবিরবাজারে পাকিস্তানি ঘাঁটিতে অতর্কিত আক্রমণ।
কসবার লাতুমুড়ায় গেরিলা অপারেশন।
প্রশিক্ষণ ও মোতায়েন: জলপাইগুড়ি ক্যাম্পে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা রংপুর-দিনাজপুরের বিভিন্ন স্থানে ক্যাম্প স্থাপন করে গেরিলা যুদ্ধ তীব্রতর করেন।
২৪ জুন ১৯৭১-এ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন বাড়লেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র সরবরাহ যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করার ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখা দেয়। মুক্তিবাহিনীর গেরিলা আক্রমণ ও রাজনৈতিক তৎপরতা পাকিস্তানি বাহিনীকে ক্রমাগত চাপে রাখে।
সূত্র
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ, সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস (সেক্টর ২)
দৈনিক ইত্তেফাক ও আজাদ, ২৫-২৬ জুন ১৯৭১
আনন্দবাজার পত্রিকা ও যুগান্তর (ভারত), ২৫-২৬ জুন ১৯৭১
মন্তব্য করুন