ঢাকা বুধবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৫, ৩০ আশ্বিন ১৪৩২
মুক্ত মনমুক্ত চিন্তামুক্তি গাথা
ধর্মীয় পরিচয়-রাজনীতির বিবর্তন

সাম্প্রদায়িকতা - মৌলবাদ - জঙ্গিবাদ - ‘আমেরিকান’ ইসলামবাদ

এ আর খান আসাদ
প্রকাশ : ২৩ জুন ২০২৫, ০২:০৭ পিএম
সাম্প্রদায়িকতা - মৌলবাদ - জঙ্গিবাদ - ‘আমেরিকান’ ইসলামবাদ

আমাদের উপমহাদেশে 'ইসলামী' রাজনীতির রূপান্তর ও তাত্ত্বিক পুনর্নির্মাণ ঘটেছে চারটি পর্বে:

১. উপনিবেশিক শাসনে ধর্মীয় পরিচয়ের জনশুমারি ও বিভাজন (১৮৭১–১৯০৯)

১৮৭১ সালে ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে প্রথম ধর্মভিত্তিক জনগণনা শুরু হয়। এটি শুধু একটি প্রশাসনিক প্রক্রিয়া ছিল না, বরং জনগণকে একেকটি 'ধর্মীয় সম্প্রদায়' হিসেবে ভাবতে শেখায় — "হিন্দু", "মুসলমান", "শিখ" ইত্যাদি। এতে 'communal consciousness' গড়ে ওঠে যা মূলত জাতিসত্তার বদলে ধর্মীয় পরিচয়কে রাজনৈতিক দাবির ভিত্তি করে তোলে। ১৯০৯ সালের মার্লে-মিন্টো সংস্কার ও পরবর্তীতে ১৯৩২ সালের কমিউনাল অ্যাওয়ার্ড এই চিন্তার আইনি রূপ দেয়। এখানে মুসলিমদের জন্য আলাদা ভোটাধিকার ও প্রতিনিধি নির্ধারণ করা হয়, যা ধর্মীয় ভিত্তিক রাজনৈতিক চেতনার পৃষ্ঠপোষকতা করে।

২. ইসলাম ও রাজনীতির একীভবন: জামাতে ইসলামী ও মৌলবাদের সূচনা (১৯৪০-এর দশক)

আবুল আ'লা মওদূদীর নেতৃত্বে ১৯৪১ সালে প্রতিষ্ঠিত জামাতে ইসলামী একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁকচিহ্ন। জামাত একটি আধুনিক সংগঠন, কিন্তু এর মূল উদ্দেশ্য ছিল একটি "ইসলামী রাষ্ট্র" প্রতিষ্ঠা, যার ভিত্তি হবে শরিয়া আইন ও ইসলামী শাসনব্যবস্থা। এদের তত্ত্ব অনুযায়ী, ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা যা কেবল ব্যক্তিগত বিশ্বাস নয়, বরং রাষ্ট্র, আইন, অর্থনীতি ও সমাজ কাঠামোও নিয়ন্ত্রণ করে। এখানেই ইসলাম প্রথমবারের মতো একটি 'আইডিয়োলজিক্যাল স্টেট'-এর দাবি তোলে।

৩. জিহাদী ইসলাম ও সহিংস ধর্মীয় রাজনীতি: ১৯৮০–৯০-এর দশক

সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধের পটভূমিতে ইসলামকে 'জিহাদ' রূপে পুনরাবিষ্কার করা হয়। মার্কিন CIA, সৌদি রাজতন্ত্র ও পাকিস্তানের আইএসআই-এর সমর্থনে এই যুদ্ধের মধ্যে একটি "মিলিট্যান্ট ইসলামিক আইডেনটিটি" গড়ে ওঠে। এ সময় একটি 'আন্তর্জাতিক ইসলামী বিপ্লবী চেতনা' তৈরি হয়, যার ভিত্তি ছিল ধর্মীয় কর্তব্য হিসেবে 'জিহাদ'। এখানে ইসলাম মূলত এক প্রকার প্রতিরোধের রাজনৈতিক ভাষা হয়ে ওঠে, যার ভিত্তি ঐতিহ্য নয়, বরং ভূরাজনৈতিক অবস্থা।

৪. ২০০০ সাল পরবর্তী, ইসলাম বনাম পশ্চিম, 'পরিচয়'- রাজনীতি ও তাত্ত্বিক পুনর্নির্মাণ

৯/১১-এর পর পশ্চিমা ও ইসলামপন্থার দ্বন্দ্ব বিশ্বরাজনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায়। এই প্রেক্ষাপটে "ইসলামী পরিচয়" নতুনভাবে আবিষ্কৃত হয় একটি "বিকল্প সভ্যতা", একটি "অপশক্তি-বিরোধী" প্রতিরোধ। এখানে কয়েকটি ধারণা গুরুত্ব পায়:

  • Islam vs West: "ইসলাম বনাম পশ্চিম" দ্বৈততা তুলে ধরে ইসলামী রাজনীতি একটি সংস্কৃতি-ভিত্তিক প্রতিরোধ কাঠামো তৈরি করে।

  • Islamic authenticity: "আসল ইসলাম" বনাম "উদার ইসলাম" — এই দ্বৈততার মধ্যে কঠোর, হানাফি-সালাফি ধাঁচের রাজনীতি বিকশিত হয়।

  • Anti-secularism: সেক্যুলারিজমকে 'নতুন উপনিবেশবাদ' হিসেবে আখ্যা দিয়ে বিশ্বে 'ইসলামী রাষ্ট্র' প্রতিষ্ঠার পক্ষে বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তি তৈরি হয়। (তালাল আসাদকে ব্যবহার করা হয়। বামপন্থীদের ম্যানিপুলেট করার চেষ্টা হয় 'জিহাদ হচ্ছে শ্রেণীসংগ্রাম' ধারণা দিয়ে। বাংলাদেশে এদের নাম হয় 'বামাতি')

২০২৪-এর রেজিমচেঞ্জের পরে, বাংলাদেশে 'আমেরিকান ইসলামবাদ' কোরআন-হাদিস থেকে নয়, আমেরিকান একাডেমিয়া থেকে (হান্টিংটন, তালাল আসাদ) 'ইসলামী' পরিচয় রাজনীতির তাত্ত্বিক যুক্তি আহরণ করে। 'শিক্ষিত' বাঙালি 'আমেরিকান' ইসলামবাদ প্রচার করে, নানা মুখোশে।

বর্তমান 'ইসলামী রাজনীতি' অনেকাংশেই ধর্মতাত্ত্বিক নয়, বরং এটি আধুনিকতা, ঔপনিবেশিকতা, রাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক ক্ষমতা কাঠামোর প্রতিক্রিয়ায় গঠিত একটি রাজনৈতিক ও পরিচয়গত আন্দোলন। এই আন্দোলন কখনও মওদূদীর 'ইসলামী রাষ্ট্র', কখনও আফগান জিহাদ, আবার কখনও তালাল আসাদের তাত্ত্বিকতা ব্যবহার করে।

আমেরিকান 'ইসলামবাদ' মূলত বিপরীত বর্ণবাদ (Reverse Racism) পরিচয় রাজনীতি, এবং পুঁজিবাদী ব্যবস্থার রক্ষাকবচ। 'পশ্চিমা' বিরোধী আন্দোলন যখন শুধু পরিচয় রাজনীতি, তখন তা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কাঠামোকে স্পর্শ করে না, ব্যবস্থাবদলাতে ব্যর্থ হয়। ফলে, পুঁজিবাদের বিদ্যমান কাঠামোকে অপরিবর্তিত রাখে, অব্যাহত রাখে, যা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অনুকূলে কাজ করে।

এই অঞ্চলে 'সাম্প্রদায়িকতা' শুরু হয় ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসকদের হাতে। এরপর এটি নানা পর্বে, মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ ও 'আমেরিকান ইসলামবাদ' হিসেবে বিকশিত হচ্ছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রয়োজনে।

লেখক: জার্মান প্রবাসী

অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

৪ অক্টোবর ১৯৭১: বিনা শর্তে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবি মধ্যপ্রদেশের বিধানসভায়

১ অক্টোবর ১৯৭১: রায়পুরের রাজাকার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গেরিলাদের আক্রমণ

হাসনাবাদ গণহত্যা (নবাবগঞ্জ, ঢাকা)

কাটেঙ্গা গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: ‘পূর্ব বাংলার সমস্যার সমাধান শেখ মুজিবের সঙ্গেই করতে হবে’

২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: “বিদেশি চাপে আমাদের বহু চেষ্টা নস্যাত হয়ে গেছে”

২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: জাতিসংঘে বাংলাদেশ নিয়ে নাটকীয়তা

সাদকপুর গণহত্যা (বুড়িচং, কুমিল্লা)

ফুলদহেরপাড়া গণহত্যা (সরিষাবাড়ী, জামালপুর)

আন্দুলিয়া গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

১০

২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বিজয়ই আমাদের একমাত্র ও চূড়ান্ত গন্তব্য

১১

জুলাই অভ্যুত্থানের প্রতারণা: জনগণের অট্টহাসি ও অবিশ্বাসের প্রতিফলন

১২

২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: চালনা বন্দরে মার্কিন জাহাজ মাইন বিস্ফোরণে ধ্বংস

১৩

বীর উত্তম আবদুস সালেক চৌধুরী: আকাশছোঁয়া হয়ে উঠেছিল যাঁর সাহস

১৪

রামনগর গণহত্যা (রায়পুরা, নরসিংদী)

১৫

২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে ভিয়েতনামের সমর্থন

১৬

মামুদপুর গণহত্যা (গোপালপুর, টাঙ্গাইল)

১৭

ত্রিমোহনী গণহত্যা ও বধ্যভূমি, নেত্রকোনা

১৮

২২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: ঢাকায় প্রাদেশিক মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠক

১৯

চিংড়া গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

২০