১৮৭১ সালে ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে প্রথম ধর্মভিত্তিক জনগণনা শুরু হয়। এটি শুধু একটি প্রশাসনিক প্রক্রিয়া ছিল না, বরং জনগণকে একেকটি 'ধর্মীয় সম্প্রদায়' হিসেবে ভাবতে শেখায় — "হিন্দু", "মুসলমান", "শিখ" ইত্যাদি। এতে 'communal consciousness' গড়ে ওঠে যা মূলত জাতিসত্তার বদলে ধর্মীয় পরিচয়কে রাজনৈতিক দাবির ভিত্তি করে তোলে। ১৯০৯ সালের মার্লে-মিন্টো সংস্কার ও পরবর্তীতে ১৯৩২ সালের কমিউনাল অ্যাওয়ার্ড এই চিন্তার আইনি রূপ দেয়। এখানে মুসলিমদের জন্য আলাদা ভোটাধিকার ও প্রতিনিধি নির্ধারণ করা হয়, যা ধর্মীয় ভিত্তিক রাজনৈতিক চেতনার পৃষ্ঠপোষকতা করে।
আবুল আ'লা মওদূদীর নেতৃত্বে ১৯৪১ সালে প্রতিষ্ঠিত জামাতে ইসলামী একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁকচিহ্ন। জামাত একটি আধুনিক সংগঠন, কিন্তু এর মূল উদ্দেশ্য ছিল একটি "ইসলামী রাষ্ট্র" প্রতিষ্ঠা, যার ভিত্তি হবে শরিয়া আইন ও ইসলামী শাসনব্যবস্থা। এদের তত্ত্ব অনুযায়ী, ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা যা কেবল ব্যক্তিগত বিশ্বাস নয়, বরং রাষ্ট্র, আইন, অর্থনীতি ও সমাজ কাঠামোও নিয়ন্ত্রণ করে। এখানেই ইসলাম প্রথমবারের মতো একটি 'আইডিয়োলজিক্যাল স্টেট'-এর দাবি তোলে।
সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধের পটভূমিতে ইসলামকে 'জিহাদ' রূপে পুনরাবিষ্কার করা হয়। মার্কিন CIA, সৌদি রাজতন্ত্র ও পাকিস্তানের আইএসআই-এর সমর্থনে এই যুদ্ধের মধ্যে একটি "মিলিট্যান্ট ইসলামিক আইডেনটিটি" গড়ে ওঠে। এ সময় একটি 'আন্তর্জাতিক ইসলামী বিপ্লবী চেতনা' তৈরি হয়, যার ভিত্তি ছিল ধর্মীয় কর্তব্য হিসেবে 'জিহাদ'। এখানে ইসলাম মূলত এক প্রকার প্রতিরোধের রাজনৈতিক ভাষা হয়ে ওঠে, যার ভিত্তি ঐতিহ্য নয়, বরং ভূরাজনৈতিক অবস্থা।
৯/১১-এর পর পশ্চিমা ও ইসলামপন্থার দ্বন্দ্ব বিশ্বরাজনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায়। এই প্রেক্ষাপটে "ইসলামী পরিচয়" নতুনভাবে আবিষ্কৃত হয় একটি "বিকল্প সভ্যতা", একটি "অপশক্তি-বিরোধী" প্রতিরোধ। এখানে কয়েকটি ধারণা গুরুত্ব পায়:
Islam vs West: "ইসলাম বনাম পশ্চিম" দ্বৈততা তুলে ধরে ইসলামী রাজনীতি একটি সংস্কৃতি-ভিত্তিক প্রতিরোধ কাঠামো তৈরি করে।
Islamic authenticity: "আসল ইসলাম" বনাম "উদার ইসলাম" — এই দ্বৈততার মধ্যে কঠোর, হানাফি-সালাফি ধাঁচের রাজনীতি বিকশিত হয়।
Anti-secularism: সেক্যুলারিজমকে 'নতুন উপনিবেশবাদ' হিসেবে আখ্যা দিয়ে বিশ্বে 'ইসলামী রাষ্ট্র' প্রতিষ্ঠার পক্ষে বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তি তৈরি হয়। (তালাল আসাদকে ব্যবহার করা হয়। বামপন্থীদের ম্যানিপুলেট করার চেষ্টা হয় 'জিহাদ হচ্ছে শ্রেণীসংগ্রাম' ধারণা দিয়ে। বাংলাদেশে এদের নাম হয় 'বামাতি')
২০২৪-এর রেজিমচেঞ্জের পরে, বাংলাদেশে 'আমেরিকান ইসলামবাদ' কোরআন-হাদিস থেকে নয়, আমেরিকান একাডেমিয়া থেকে (হান্টিংটন, তালাল আসাদ) 'ইসলামী' পরিচয় রাজনীতির তাত্ত্বিক যুক্তি আহরণ করে। 'শিক্ষিত' বাঙালি 'আমেরিকান' ইসলামবাদ প্রচার করে, নানা মুখোশে।
বর্তমান 'ইসলামী রাজনীতি' অনেকাংশেই ধর্মতাত্ত্বিক নয়, বরং এটি আধুনিকতা, ঔপনিবেশিকতা, রাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক ক্ষমতা কাঠামোর প্রতিক্রিয়ায় গঠিত একটি রাজনৈতিক ও পরিচয়গত আন্দোলন। এই আন্দোলন কখনও মওদূদীর 'ইসলামী রাষ্ট্র', কখনও আফগান জিহাদ, আবার কখনও তালাল আসাদের তাত্ত্বিকতা ব্যবহার করে।
আমেরিকান 'ইসলামবাদ' মূলত বিপরীত বর্ণবাদ (Reverse Racism) পরিচয় রাজনীতি, এবং পুঁজিবাদী ব্যবস্থার রক্ষাকবচ। 'পশ্চিমা' বিরোধী আন্দোলন যখন শুধু পরিচয় রাজনীতি, তখন তা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কাঠামোকে স্পর্শ করে না, ব্যবস্থাবদলাতে ব্যর্থ হয়। ফলে, পুঁজিবাদের বিদ্যমান কাঠামোকে অপরিবর্তিত রাখে, অব্যাহত রাখে, যা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অনুকূলে কাজ করে।
এই অঞ্চলে 'সাম্প্রদায়িকতা' শুরু হয় ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসকদের হাতে। এরপর এটি নানা পর্বে, মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ ও 'আমেরিকান ইসলামবাদ' হিসেবে বিকশিত হচ্ছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রয়োজনে।
লেখক: জার্মান প্রবাসী
মন্তব্য করুন