১৯৭১ সালের ২৫ জুন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিন। এদিন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ জানানো হয়, ভারতীয় নেতৃত্ব বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করে এবং মুক্তিবাহিনী দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সফল অভিযান চালায়।
এদিন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ইসলামী সম্মেলন সংস্থা (ওআইসি)-এর মহাসচিব টুংকু আবদুল রহমানকে একটি জরুরি তারবার্তা পাঠান। তাতে তিনি বাংলাদেশে চলমান গণহত্যা বন্ধে ওআইসির হস্তক্ষেপ কামনা করেন। নজরুল ইসলাম বলেন, "পাকিস্তানি বাহিনী ধর্মের নামে বাংলাদেশে নারকীয় গণহত্যা চালাচ্ছে, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে, নারীদের ধর্ষণ করছে। ওআইসি যদি ইসলামী নীতিতে বিশ্বাসী হয়, তবে তাদের এই বর্বরতার প্রতিবাদ করা উচিত।"
উল্লেখ্য, এর আগে জেদ্দায় ওআইসির সম্মেলনে পাকিস্তানের "একতা ও সংহতি" রক্ষার পক্ষে সমর্থন দেওয়া হয়েছিল। বাংলাদেশ সরকারের এই আহ্বান ছিল ওআইসির সেই অবস্থানকে চ্যালেঞ্জ করার একটি কূটনৈতিক প্রয়াস।
দিল্লিতে "পূর্ব বাংলায় চলমান জটিলতা ও সমাধান" শীর্ষক তিন দিনব্যাপী এক আলোচনায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, "এ মুহূর্তে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে তাৎক্ষণিক লাভ নেই। আমরা পাকিস্তানের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ানোর চেষ্টা করছি।" তিনি উল্লেখ করেন, ৬০ লাখ শরণার্থীর ভারতে অবস্থান দেশের অর্থনীতির ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং সংসদীয় কমিটিতে সতর্ক করে বলেন, "যদি শিগগির বাংলাদেশের জন্য রাজনৈতিক সমাধান না আসে, ভারতকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।"
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর এদিন পাকিস্তানকে দেওয়া দুটি অস্ত্র সরবরাহের লাইসেন্স বাতিলের ঘোষণা দেয়। তবে এ নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়, কারণ লাইসেন্স দুটি ৩১ মার্চ ও ৬ এপ্রিল মঞ্জুর করা হয়েছিল—যা বাংলাদেশে গণহত্যা শুরুর পরের ঘটনা।
দিল্লিতে বাংলাদেশ মিশনের দ্বিতীয় সচিব কে. এম. শেহাবউদ্দিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ করেন এবং পাকিস্তানকে সামরিক সহায়তা বন্ধের দাবি জানান। একই দিনে ভারতীয় জনসংঘের নেতৃত্বে মার্কিন দূতাবাসের সামনে আরও একটি বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্স জাতিসংঘের শরণার্থী হাইকমিশনারকে জানান, শরণার্থীদের জন্য অতিরিক্ত ৭ কোটি ডলার সাহায্য দেওয়া হবে।
পূর্ব জার্মানি ৬০ লাখ মার্কিন ডলার মূল্যের সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দেয়।
অস্ট্রিয়া ১ লাখ ডলার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেয়।
টাঙ্গাইল: কাদেরিয়া বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা নাগরপুর থানায় হামলা চালিয়ে অস্ত্র ও রেডিও সরঞ্জাম লুট করে। পুলিশ বাহিনী আত্মসমর্পণ করে।
ময়মনসিংহ: ভালুকায় আফসার বাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের ৪৮ ঘণ্টাব্যাপী যুদ্ধে ৯৫ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়।
মৌলভীবাজার: মুক্তিযোদ্ধারা বিয়ানীবাজার থানা সার্কেল অফিসে গ্রেনেড হামলা চালায় এবং সমনবাগ চা বাগানে আক্রমণ করে ১৫ জন রাজাকার ও প্রহরী নিহত হয়।
লক্ষ্মীপুর: মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে পাকিস্তানিদের বাগবাড়ি ক্যাম্পে হতাহতের ঘটনা ঘটে।
পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ দাবি করে, ভারতে থাকা শরণার্থীদের ফিরিয়ে আনতে ২৩টি অভ্যর্থনা শিবির তৈরি করা হয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক সাংবাদিকদের রিপোর্টে দেখা যায়, এসব শিবিরে শরণার্থীদের উপস্থিতি নগণ্য।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এ. আর. মল্লিক লক্ষ্ণৌতে এক সমাবেশে বলেন, "পাকিস্তানি বাহিনী শুধু বুদ্ধিজীবী হত্যাই নয়, বাংলাদেশের সম্পদও লুট করছে। বিশ্ববাসীর কাছে আমাদের আহ্বান, এই গণহত্যার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান।"
সূত্র
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র (৭ম, ১০ম, ১২শ, ১৩শ খণ্ড)
দৈনিক ইত্তেফাক, আজাদ, আনন্দবাজার পত্রিকা (২৬ জুন ১৯৭১)
আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থার প্রতিবেদন (এপি, ইউনাইটেড প্রেস)
মন্তব্য করুন