বাংলাদেশে মব সন্ত্রাস ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নিপীড়নের ঘটনা ক্রমাগত উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি লালমনিরহাটে হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত এক নরসুন্দর বাবা-ছেলের ওপর ‘ধর্মীয় অবমাননার’ অভিযোগ তুলে যেভাবে মব সন্ত্রাস চালানো হয়েছে, তা বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য মারাত্মক হুমকি। এই ঘটনা শুধু বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়; বরং এটি বিচারহীনতার সংস্কৃতির এক করুণ উদাহরণ।
লালমনিরহাটের ঘটনা: মব সন্ত্রাসের বাস্তবতা
লালমনিরহাট সদর উপজেলার গোশালা বাজার এলাকার পরেশ চন্দ্র শীল ও তার ছেলে বিষ্ণু চন্দ্র শীলের ওপর হামলার ঘটনাটি ধর্মীয় অনুভূতির আঘাতের অভিযোগে সংঘটিত হয়। স্থানীয়দের ভাষ্য অনুযায়ী, ঘটনাটি শুরু হয় চুল কাটার টাকা নিয়ে তর্কবিতর্ক থেকে। পরে এটিকে ধর্মীয় ইস্যু বানিয়ে মব সন্ত্রাস চালানো হয়। মারধরের পর তাদের পুলিশের হাতে সোপর্দ করা হয়, আর থানায় উপস্থিত উত্তেজিত জনতার সামলাতে ওসি নূরনবীর বিতর্কিত বক্তব্য পরিস্থিতি আরও জটিল করে তোলে।
বিচারহীনতার সংস্কৃতির ফলে পুনরাবৃত্তি
আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এবং অন্যান্য মানবাধিকার সংগঠন সঠিকভাবে উল্লেখ করেছে যে, বিচারহীনতার সংস্কৃতি এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাতে সাহায্য করে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা এবং মব সন্ত্রাসের ঘটনা বারবার ঘটছে, কিন্তু এসব ক্ষেত্রে কার্যকর বিচার হওয়ার নজির কম। দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়া শুধুমাত্র আইনের শাসনের অবক্ষয়ই নয়, বরং সামাজিক সম্প্রীতির জন্যও তা গভীর উদ্বেগের কারণ।
মব সন্ত্রাসের পরিণতি: আইনের শাসন ও সামাজিক সম্প্রীতির অবক্ষয়
মব সন্ত্রাস শুধু একটি ব্যক্তিকে বা পরিবারকে নিপীড়ন করে না, এটি একটি সমাজের সাম্প্রদায়িক সৌহার্দ্য এবং আইনের প্রতি বিশ্বাসকে ভেঙে দেয়। ধর্মীয় অনুভূতি অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি বিষয়। তবে কোনো অভিযোগ উঠলে তা আইনি প্রক্রিয়ায় নিষ্পত্তি হওয়া উচিত। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা সমাজে অরাজকতার জন্ম দেয়।
অতীতের ঘটনাগুলোর শিক্ষা
বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নিপীড়নের ঘটনা নতুন নয়। রামু, নাসিরনগর এবং ভোলায় সংঘটিত হামলার মতো ঘটনাগুলো এখনো আমাদের স্মৃতিতে দগদগে। প্রতিটি ঘটনার পেছনে ছিল ভুল তথ্য, মিথ্যা অভিযোগ বা ইচ্ছাকৃত উসকানি। এসব ঘটনার পরও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি, যা বিচারহীনতার সংস্কৃতি আরও শক্তিশালী করেছে।
কীভাবে প্রতিরোধ সম্ভব?
১. স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ তদন্ত: প্রতিটি ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত নিশ্চিত করতে হবে। ২. দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি: মব সন্ত্রাসে জড়িত ব্যক্তিদের দ্রুত শাস্তি নিশ্চিত করা উচিত। ৩. সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় উদ্যোগ: সরকারের পক্ষ থেকে আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। ৪. আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বশীল আচরণ: আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ঘটনাস্থলে দায়িত্বশীল আচরণ এবং উত্তেজনা প্রশমনে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। ৫. সচেতনতা বৃদ্ধি: ধর্মীয় উগ্রতা ও মিথ্যা প্রচারণা বন্ধে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি।
মব সন্ত্রাস একটি জাতির উন্নয়নের পথে অন্যতম বড় বাধা। এটি একটি সমাজের ভিতর থেকে ভাঙন সৃষ্টি করে। লালমনিরহাটের ঘটনা একটি সতর্কবার্তা যে, এখনই ব্যবস্থা নেওয়া না হলে ভবিষ্যতে আরও গুরুতর সামাজিক বিভাজন সৃষ্টি হবে। সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও অধিকার রক্ষায় সরকার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষকে একযোগে কাজ করতে হবে। বিচারহীনতার সংস্কৃতির অবসান ঘটিয়ে একটি মানবিক ও সহমর্মিতাপূর্ণ সমাজ গড়ে তুলতে এখনই পদক্ষেপ নেওয়া সময়ের দাবি।
মন্তব্য করুন