জাহাজ দুটিতে আটটি জঙ্গিবিমান, প্যারাস্যুট, কামান, ট্যাংকের যন্ত্রাংশ, গোলাবারুদ ও অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম ছিল। এসব অস্ত্র মার্কিন বিমানবাহিনীর উদ্বৃত্ত মজুদ থেকে সস্তায় বিক্রি করা হয়। নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২৫ মার্চের পর পাকিস্তানে অস্ত্র পাঠানো নীতিবিরুদ্ধ হলেও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে এই সরবরাহ অব্যাহত থাকে। এমনকি, অপারেশন সার্চলাইটে ব্যবহৃত অস্ত্রও মার্কিন সরবরাহ থেকে এসেছিল বলে প্রতিবেদনে দাবি করা হয়।
এই খবরে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, "মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করে, তবে তা তাদের পূর্বের প্রতিশ্রুতির সরাসরি লঙ্ঘন।" অন্যদিকে, জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার নিষ্ক্রিয়তাও সমালোচিত হয়।
মুজিবনগর সরকারের তৎপরতা বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ মুজিবনগরে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের উদ্দেশে ভাষণ দেন। তিনি বলেন, "এ মুহূর্তের প্রধান লক্ষ্য শত্রুমুক্ত ভূমিতে শরণার্থীদের ফিরিয়ে আনা।" তিনি ভারতের জনগণ ও সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান, যারা লক্ষাধিক শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে।
নেদারল্যান্ডস সফররত বাংলাদেশের বিশেষ দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ডাচ সংসদীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে বাংলাদেশের গণহত্যার বিবরণ দেন। ডাচ সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান বলেন, "পাকিস্তানের এই নৃশংসতার পর বাংলাদেশের পৃথক রাষ্ট্র হওয়াই যুক্তিযুক্ত।"
ভারতের রাজনৈতিক আলোচনা দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী-র সভাপতিত্বে নব কংগ্রেসের সংসদীয় দলের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে কয়েকজন সাংসদ বাংলাদেশের পক্ষে সরাসরি হস্তক্ষেপের দাবি তোলেন। কাশ্মীরের সৈয়দ আহমদ আগার বলেন, "পাকিস্তানের বিভক্তি মুসলিমবিরোধী নয়; বরং পাকিস্তানের অত্যাচারই ইসলামবিরোধী।" অন্ধ্রপ্রদেশের পি. ভেঙ্কট সুদ্বিয়ার প্রশ্ন তোলেন, "আন্তর্জাতিক চাপ সত্ত্বেও ভারত কি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা নিতে প্রস্তুত?"
এদিন সুচেতা কৃপালনি-র নেতৃত্বে আদি কংগ্রেসের একটি দল পশ্চিমবঙ্গের শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করে। তিনি বলেন, "ভারত সরকার দ্রুত সিদ্ধান্ত না নেওয়ায় পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়েছে।" পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখোপাধ্যায় রেডিওতে ভাষণ দিয়ে শরণার্থীদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করেন এবং স্থানীয়দের সঙ্গে সংঘাত এড়ানোর আহ্বান জানান।
পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ অবস্থা করাচিতে জুলফিকার আলী ভুট্টো বিদেশি সাহায্য বন্ধের হুমকিকে "অপমানজনক" বলে আখ্যায়িত করেন। পাকিস্তান মুসলিম লীগের খান আবদুল কাইয়ুম খান শেখ মুজিবুর রহমানের সমর্থকদের রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ করার দাবি তোলেন। জামায়াতে ইসলামীর গোলাম আযম ও নেজামে ইসলামীর মওলানা শামসুল হক সামরিক শাসন দীর্ঘায়িত করার পক্ষে অবস্থান নেন।
ঢাকায় সামরিক প্রশাসন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সব দেয়াললিখন ও নির্বাচনী প্রতীক মুছে ফেলার নির্দেশ দেয়। অন্যদিকে, প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য এস.বি. জামান সেনাবাহিনীর দমননীতির প্রশংসা করে বলেন, "শান্তি কমিটির মাধ্যমে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে।"
মুক্তিযোদ্ধাদের অভিযান মুক্তিবাহিনী সেদিন কুমিল্লার রাজাপুর, খুলনার বৈকরি, যশোরের বেনাপোল ও বগুড়ার পাঁচবিবিতে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর সফল আক্রমণ চালায়। কুমিল্লার অপারেশনে একজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন, তবে ১৫ জন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।
ব্রিটিশ প্রতিনিধিদলের পাকিস্তান সফর যুক্তরাজ্যের একটি সংসদীয় দল পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে করাচি পৌঁছায়। দলে ছিলেন লেবার পার্টির আর্থার বটমলি ও কনজারভেটিভ পার্টির জেমস র্যামডেন। তারা ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনা করে ত্রাণ সহায়তা নিশ্চিত করার কথা বলেন।
সূত্র
নিউইয়র্ক টাইমস, ২২ জুন ১৯৭১
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র
দৈনিক ইত্তেফাক, পাকিস্তান, অমৃতবাজার পত্রিকা (২৩ জুন ১৯৭১)
মন্তব্য করুন