বর্তমানে বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ এবং পরিবেশ দূষণ বালাইনাশক শিল্পের টেকসই উন্নয়নের অন্তরায়। এই সমস্যা সমাধানে কার্যকরী এবং নিরাপদ সবুজ বালাইনাশকের বিকাশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু নতুন বালাইনাশক যৌগ তৈরি করা ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ায় গবেষকরা বর্তমান বালাইনাশকের কার্যকারিতা বাড়ানোর জন্য উন্নত প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতির দিকে ঝুঁকছেন। এর মাধ্যমে সক্রিয় উপাদানগুলোর জৈবিক ক্রিয়াকলাপ এবং কার্যকারিতা বাড়ানো সম্ভব, যা বালাইনাশকের ব্যবহার হ্রাস করতে এবং কার্যক্ষমতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
কৃষিক্ষেত্রে ন্যানো প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশের ফলে ন্যানো-বালাইনাশকের আবির্ভাব ঘটেছে, যা পরিবেশ দূষণ এবং ক্ষতিকর অবশিষ্টাংশের মতো প্রচলিত বালাইনাশকের সাথে সম্পর্কিত সমস্যাগুলো সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। ন্যানো-বালাইনাশক হলো প্রচলিত বালাইনাশকের নতুন এবং উন্নত সংস্করণ যা ন্যানো প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি করা হয়। ন্যানো প্রযুক্তি হলো অতিক্ষুদ্র স্কেলে (১-১০০ ন্যানোমিটার) পদার্থের ক্ষুদ্র কণা নিয়ে কাজ করা। এই ক্ষুদ্র কণাগুলোর অনন্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যেমন ক্ষুদ্র আকারের প্রভাব, বৃহৎ আপেক্ষিক পৃষ্ঠতলের ক্ষেত্রফল, উচ্চ প্রতিক্রিয়া এবং কোয়ান্টাম প্রভাব, যা বালাইনাশকের কার্যকারিতা উন্নত করতে এবং পরিবেশগত প্রভাব কমাতে ব্যবহার করা যেতে পারে।
ন্যানো-বালাইনাশকের বিকাশ কৃষিক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। ন্যানো উপকরণ এবং প্রযুক্তি ব্যবহার করে বালাইনাশকের সক্রিয় উপাদান, বাহক এবং অ্যাডজুভান্টগুলোকে (সহযোগী উপাদান) আরও কার্যকরী নতুন ডোজ ফর্মে প্রক্রিয়াকরণ করা হয়, যার ফলে দুর্বল দ্রবণীয় বালাইনাশকের দ্রবণীয়তা, স্থিতিশীলতা এবং কার্যকারিতা বাড়ে, পরিবেশগত দূষণ কমে এবং টেকসই কৃষি চর্চাকে উন্নীত করে। ২০১৯ সালে, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অফ পিওর অ্যান্ড অ্যাপ্লায়েড কেমিস্ট্রি (IUPAC) কর্তৃক ন্যানোপেস্টিসাইডগুলো বিশ্বকে বদলে দেবে এমন শীর্ষ দশটি উদীয়মান রাসায়নিক প্রযুক্তির মধ্যে স্থান পেয়েছিল। ইউএস এনভায়রনমেন্টাল প্রোটেকশন এজেন্সি (ইপিএ), ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইউনাইটেড নেশনস অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি) এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানগুলো ন্যানোপেস্টিসাইড উৎপাদন, ব্যবহার এবং নিরাপত্তা মূল্যায়নের জন্য ব্যবস্থাপনা নীতিমালা প্রণয়ন করেছে।
ন্যানো-বালাইনাশক তৈরির পদ্ধতি
বর্তমানে আন্তর্জাতিকভাবে ন্যানো-বালাইনাশকের কোনো সর্বজনীন সংজ্ঞা নেই। কাহ এবং অন্যান্য গবেষকরা ন্যানো-বালাইনাশককে ১,০০০ ন্যানোমিটারের কম কণার আকারবিশিষ্ট, ‘ন্যানো’ উপসর্গযুক্ত অথবা ক্ষুদ্র আকারের সাথে সম্পর্কিত নতুন বৈশিষ্ট্যযুক্ত বালাইনাশক হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। ন্যানো-বালাইনাশক প্রস্তুত করার দুটি প্রধান পদ্ধতি রয়েছে:
সরাসরি প্রক্রিয়াকরণ: বালাইনাশকের সক্রিয় উপাদানগুলোকে সরাসরি ন্যানো-স্কেলে কণায় পরিণত করা হয়। যেমন: মাইক্রোইমালশন, ন্যানোইমালশন এবং ন্যানোডিসপারশন।
ন্যানো-বাহক ব্যবহার: ন্যানো উপাদানকে বাহক হিসেবে ব্যবহার করে শোষণ, সংযোজন, মোড়ানো বা সংযোগস্থাপন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বালাইনাশক প্রস্তুত করা হয়। সাধারণত ব্যবহৃত ন্যানো-বাহক উপকরণগুলোর মধ্যে রয়েছে পলিমার, কঠিন লিপোসোম, সিলিকা, স্তরিত ডাবল হাইড্রোক্সাইড, কাদামাটি এবং অজৈব কার্বন ইত্যাদি। এগুলো ন্যানো-মাইক্রোক্যাপসুল, ন্যানোস্ফিয়ার, ন্যানোমাইসেলস, ন্যানোজেল এবং ন্যানোফাইবার ইত্যাদি বালাইনাশক তৈরিতে ব্যবহার করা যেতে পারে।
এছাড়াও কিছু ধাতু এবং ধাতব অক্সাইড ন্যানোকণার ব্যাকটেরিয়া নিধন এবং অনুঘটক অবক্ষয়ের কাজ রয়েছে। বালাইনাশকের সাথে এগুলোর সম্মিলিত ব্যবহার বালাইনাশকের কার্যকারিতা উন্নত করতে পারে।
ন্যানো-বালাইনাশকের কার্যকারিতা
স্বল্প দ্রবণীয় বালাইনাশকের সঠিক মিশ্রণ না হওয়া বালাইনাশকের কার্যকারিতা হ্রাসের একটি অন্যতম প্রধান কারণ। ইমালসিফাইয়েবল কনসেন্ট্রেট এবং দ্রবণীয় পাউডারের মতো প্রচলিত বালাইনাশক ফর্মুলেশনে প্রচুর পরিমাণে জৈব দ্রাবকের ব্যবহার, বালাইনাশকের অপচয় এবং কম কার্যকারিতার মতো সীমাবদ্ধতা রয়েছে। প্রচলিত বালাইনাশকের তুলনায় ন্যানো-বালাইনাশকের কণার আকার ছোট এবং আপেক্ষিক পৃষ্ঠের ক্ষেত্রফল বেশি হওয়ায় স্বল্প দ্রবণীয় বালাইনাশকের পানিতে মিশে যাওয়ার সক্ষমতা উন্নত হয় এবং উদ্ভিদের পাতায় বা ক্ষতিকর জীবের উপর বালাইনাশকের সংস্পর্শ বৃদ্ধি পায়।
ভালো দ্রবণীয়তা এবং পাতায় লেগে থাকার ক্ষমতা নিশ্চিত করে যে, মাঠে প্রয়োগের সময় ন্যানো-বালাইনাশকগুলো লক্ষ্যস্থলে সমানভাবে পৌঁছায়। অত্যধিক বড় বালাইনাশক কণার কারণে ঝরে পড়া বা অপচয় রোধ করে এবং বালাইনাশকের লক্ষ্যস্থলে পৌঁছানো নিশ্চিত করে। এর ফলে বালাইনাশকের কার্যক্ষমতা অনেক বেড়ে যায়। উপযুক্ত আকারের ন্যানো-কণা দ্রুত এবং স্থায়ী বালাইনাশক প্রভাবের মধ্যে ভারসাম্য নিশ্চিত করতে পারে, যার ফলে বালাইনাশক প্রয়োগের মাত্রা এবং হার হ্রাস পায় এবং বালাইনাশকের সক্ষমতার হার উন্নত হয়।
ফসলের পাতায় মোমের আবরণ, স্টোমাটা, ভিলি এবং এপিডার্মাল কোষের মতো কাঠামো থাকায় এরা কিছুটা জলবিদ্বেষী হয়। এর ফলে স্প্রে করা বালাইনাশক পাতায় লেগে থাকতে পারে না এবং এর ফলে প্রচুর বালাইনাশক নষ্ট হয়ে যায়। ন্যানো উপাদান এবং প্রযুক্তির ব্যবহার ওষুধের লক্ষ্যবস্তুর প্রতি আসক্তি বাড়াতে পারে, বালাইনাশকের অপচয় কমাতে পারে এবং বালাইনাশকের ব্যবহার উন্নত করতে পারে।
প্রচলিত বালাইনাশক প্রয়োগের পরে পরিবেশে দ্রুত অবক্ষয়ের কারণে, কার্যকরী মাত্রা বজায় রাখতে ফসলের বৃদ্ধির সময়কালে বারবার প্রয়োগ করার প্রয়োজন হয়। ন্যানো প্রযুক্তি ব্যবহার করে, বালাইনাশকের নিঃসরণ বৈশিষ্ট্যগুলোকে ক্ষতিকর জীবের আক্রমণের ধরন এবং নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তার সাথে খাপ খাইয়ে দীর্ঘস্থায়ী ন্যানো-বালাইনাশক তৈরি করা সম্ভব। এর ফলে বালাইনাশকের পরিমাণ এবং প্রয়োগের হার কমে যায় এবং বালাইনাশকের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত হয়। এছাড়াও, ক্ষতিকর জীবের আক্রমণের সময়, ক্ষতির পরিমাণ, তাদের বাস্তুসংস্থান এবং বিভিন্ন চাষাবাদের বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে এনজাইম, পিএইচ, তাপমাত্রা এবং আলোর মতো পরিবেশগত কারণের প্রতি সাড়া দিতে সক্ষম সুনির্দিষ্ট ন্যানো-বালাইনাশক তৈরি করা সম্ভব। এর মাধ্যমে বালাইনাশকের সর্বোচ্চ নিঃসরণ এবং জৈবিক নিয়ন্ত্রণের মাত্রা সমন্বয় করে বালাইনাশকের কার্যকারিতা নিশ্চিত করা যায়।
বিভিন্ন ধরণের বালাইনাশক রয়েছে এবং এদের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার পদ্ধতি জটিল হলেও এদের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। প্রথমত, এগুলোকে ফসলের উপর প্রয়োগ করতে হয়। এরপর, এগুলো পাতার মধ্য দিয়ে প্রসারিত, শোষিত এবং পরিবাহিত হয়ে পরিশেষে উদ্ভিদের দেহে পৌঁছায়। উদ্ভিদের অভ্যন্তরে বা বাইরের বালাইপতঙ্গের সংস্পর্শে এসে সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয় উপায়ে এগুলো বালাইপতঙ্গের মৃত্যু ঘটায়। ন্যানো-বালাইনাশকের বাহক গাছের শোষণ ও পরিবহন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করে বালাইনাশকের সক্ষমতা বাড়াতে পারে। ফলে ফসলের মধ্যে বালাইনাশকের বিস্তার বৃদ্ধি পায় এবং সক্রিয় উপাদানগুলো সঠিক জায়গায় পৌঁছাতে পারে। এর ফলে ফসলের বালাইনাশক কার্যক্ষমতার হার অনেক বৃদ্ধি পায়।
ন্যানো-বালাইনাশক: সমস্যা ও সম্ভাবনা
পরিবেশবান্ধব বালাইনাশক উদ্ভাবন, বালাইনাশকের ব্যবহার উন্নত করা, প্রয়োগের পরিমাণ হ্রাস এবং দক্ষতা বৃদ্ধি এবং টেকসই কৃষি উন্নয়ন বালাইনাশক শিল্পের বিকাশের মূল লক্ষ্য। বর্তমানে ন্যানো-বালাইনাশক নিয়ে গবেষণা এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। যদিও কিছু বালাইনাশক কোম্পানি বিপুল সংখ্যক ন্যানো-বালাইনাশকের পেটেন্টের জন্য আবেদন করেছে, বাজারে মাইক্রোইমালশন ছাড়া খুব কম সংখ্যক ন্যানো-বালাইনাশক পাওয়া যায়। ন্যানো উপাদানের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ন্যানো-বালাইনাশকের নিরাপত্তা নিয়ে ব্যাপক উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। এর ফলে ন্যানো-বালাইনাশকের বিষক্রিয়া মূল্যায়নের জন্য এখনও কোনো সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড তৈরি হয়নি। প্রথাগত বালাইনাশকের বিষক্রিয়া কেবল বালাইনাশকের সক্রিয় উপাদানের ঘনত্বের সাথে সম্পর্কিত।
কিন্তু ন্যানো-বালাইনাশকের ক্ষেত্রে বাহক ন্যানোকণার ধরন এবং ন্যানো-বালাইনাশকের লোডিং সিস্টেমে বালাইনাশকের অনুপাত বিবেচনা করা প্রয়োজন। গবেষকরা প্রস্তাব করেছেন যে মাটির অণুজীব, পরাগবাহী পোকা, উপকারী পোকা এবং অন্যান্য অ-লক্ষ্যবস্তু জীবের উপর ন্যানো-বাহকের প্রভাব নিয়ে পদ্ধতিগতভাবে গবেষণা করা উচিত। পাশাপাশি, ফসলের ভোজ্য অংশে ন্যানোকণার শোষণ, সঞ্চয় এবং স্থানান্তর প্রক্রিয়া নিয়েও গবেষণা প্রয়োজন। বর্তমানে ন্যানো-বালাইনাশকের বিষক্রিয়া নিয়ে খুব সীমিত সংখ্যক পদ্ধতিগত প্রতিবেদন রয়েছে। অধিকাংশ গবেষণায় কেবল পরীক্ষাগারে বর্তমান বালাইনাশকের বিষক্রিয়া মূল্যায়নের মান ব্যবহার করে নতুন সংশ্লেষিত ন্যানো-বালাইনাশকের কার্যকারিতা যাচাই করা হয়। পাশাপাশি, বর্তমানে, একটি উদ্ভাবনী প্রযুক্তি হিসাবে ন্যানো-বালাইনাশকের বালাইনাশক নিবন্ধনে এখনও কিছু বাধা রয়েছে। তাই, ন্যানো-বালাইনাশকের নিবন্ধন এবং প্রয়োগ প্রদর্শন প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করা ন্যানো-বালাইনাশক ফর্মুলেশনের উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, কৃষি রসায়ন বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা | গবেষক, উমিও বিশ্ববিদ্যালয়, সুইডেন।
মন্তব্য করুন