দেশজুড়ে শিশু ও নারী ধর্ষণের ঘটনা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। সম্প্রতি কুষ্টিয়ায় একটি শিশু ধর্ষণের ঘটনায় চপেটাঘাতের মাধ্যমে তথাকথিত ‘বিচার’ সম্পন্ন হয়েছে—এটি আইনের প্রতি সমাজের অবহেলা ও বিচারব্যবস্থার দুর্বলতারই প্রতিচ্ছবি। অন্যদিকে, হবিগঞ্জ, গাজীপুর, রাজবাড়ী, নাটোর ও মৌলভীবাজারের মতো জেলাগুলোতে ধর্ষণ, হত্যা ও যৌন সহিংসতার ঘটনা প্রমাণ করছে, ধর্ষণ এখন একটি সামাজিক মহামারিতে পরিণত হয়েছে।
গত কয়েকদিনের সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরগুলো দেখলে চোখ কপালে ওঠার মতো অবস্থা:
হবিগঞ্জের নবীগঞ্জে একটি চলন্ত বাসে কলেজছাত্রীকে দলবদ্ধ ধর্ষণ করা হয়েছে।
গাজীপুরের শ্রীপুরে একটি এটিএম বুথে একজন পোশাক শ্রমিক ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।
রাজবাড়ীর পাংশায় দুই স্কুলছাত্রীকে জিম্মি করে ধর্ষণ করা হয়েছে।
নাটোরের বড়াইগ্রামে একটি কিশোরী ধর্ষণের শিকার হয়েছে।
মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের পর এক স্কুলছাত্রীকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে।
এই ঘটনাগুলো শুধু বিচ্ছিন্ন অপরাধ নয়, বরং একটি পদ্ধতিগত সহিংসতার ধারাবাহিকতা। গত মার্চে মাগুরার শিশু আছিয়ার ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের পর সরকার দ্রুত বিচারের জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু শুধু আইন কঠোর করলেই কি এই অপরাধ বন্ধ হবে?
ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু সমস্যা হলো, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মামলাই হয় না। আর মামলা হলেও দীর্ঘসূত্রতা, দুর্বল তদন্ত ও আইনের ফাঁকফোকরে অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। কুষ্টিয়ার মতো জায়গায় সালিশের নামে চপেটাঘাত দিয়ে ধর্ষণের "বিচার" করা হচ্ছে—এটি আইনের প্রতি মানুষের আস্থাহীনতারই প্রকাশ।
প্রশ্ন হলো:
ধর্ষণের শিকার হওয়ার পরেও কেন নারীরা মামলা করতে ভয় পায়?
কেন সমাজপতিরা সালিশের নামে অপরাধীদের রক্ষা করে?
কেন পুলিশ ও প্রশাসন দ্রুত পদক্ষেপ নেয় না?
১. আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জবাবদিহিতা:
ধর্ষণের প্রতিটি ঘটনায় দ্রুত তদন্ত ও অপরাধীদের গ্রেপ্তার নিশ্চিত করতে হবে।
পুলিশ ও প্রশাসনকে নারী-অধিকার বিষয়ে সংবেদনশীল করে তুলতে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন।
২. দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা:
বিশেষ ট্রাইব্যুনালগুলোকে আরও কার্যকর করতে হবে।
মামলার দীর্ঘসূত্রতা কমাতে ডিজিটাল সাক্ষ্য ও ফরেনসিক প্রমাণের ব্যবহার বাড়ানো দরকার।
৩. সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন:
ধর্ষণকে "লজ্জার বিষয়" হিসেবে না দেখে একে একটি গুরুতর অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে সমাজকে সচেতন করতে হবে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মিডিয়ার মাধ্যমে লিঙ্গসমতা ও নারী অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো জরুরি।
৪. রাস্তা থেকে রাজনৈতিক অঙ্গন—সব জায়গায় নিরাপত্তা:
চলন্ত বাস, এটিএম বুথ, স্কুল-কলেজের আশেপাশে নিরাপত্তা বাড়াতে হবে।
নারীদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
ধর্ষণ রোধে শুধু কঠোর শাস্তির আইন করলেই চলবে না। প্রয়োজন একটি সমন্বিত উদ্যোগ—যেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিচারব্যবস্থা, প্রশাসন ও সমাজ সবাই একসাথে কাজ করবে। নারীরা যেন ন্যায়বিচার পায়, অপরাধীরা যেন কোনোভাবেই পার না পায়—সেটা নিশ্চিত করতে হবে। কুষ্টিয়ার মতো "সালিশি বিচার" যেন আর কখনোই ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধের "সমাধান" না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।
সরকার, প্রশাসন ও সমাজ—সবাইকে এখনই জেগে উঠতে হবে। নইলে এই মহামারী থামানো যাবে না।
মন্তব্য করুন