কাশ্মীরের পেহেলগামে সম্প্রতি বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ জন নিরীহ পর্যটকের নির্মম হত্যাকাণ্ড কেবল একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এটি বিশ্বব্যাপী জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদের ক্রমবর্ধমান হুমকির একটি ভয়াবহ প্রতিচ্ছবি। এই নৃশংসতা আমাদের সম্মিলিত মানবতাকে এক গভীর প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে: আর কতকাল এমন বর্বরতা চলবে? কেন আদর্শিক বা রাজনৈতিক স্বার্থের নামে মানুষ এমন অমানবিক নিষ্ঠুরতায় লিপ্ত হতে পারে? এই প্রেক্ষাপটে, জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদের মূল কারণ, এর ভয়াবহ পরিণতি এবং একটি মানবিক বিশ্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সম্মিলিত পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা প্রয়োজন।
জঙ্গিবাদ: মানবতার বিরুদ্ধে এক বিষাক্ত চ্যালেঞ্জ জঙ্গিবাদ কোনো নির্দিষ্ট ধর্ম, জাতি বা অঞ্চলের সমস্যা নয়; এটি সমগ্র মানবজাতির অস্তিত্বের জন্য একটি গুরুতর হুমকি। পেহেলগামের কাপুরুষোচিত হামলা তারই প্রমাণ। জঙ্গিরা ভীতি ও ত্রাস সৃষ্টির মাধ্যমে সমাজে অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে চায়। তারা মনে করে, এই ভয়ের রাজনীতি তাদের উদ্দেশ্য সফল করবে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ভীতি কখনো স্থায়ী শান্তি বয়ে আনতে পারে না।
জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ এবং উগ্রপন্থা আজ বিশ্বজুড়ে বিস্তৃত একটি জটিল সমস্যা। এর প্রধান শিকার হলো নিরীহ সাধারণ মানুষ, যারা কেবল ভুল সময়ে ভুল জায়গায় থাকার কারণে চরম মূল্য দিতে বাধ্য হয়। পেহেলগামের পর্যটকদের ওপর হামলা তেমনই এক মর্মান্তিক দৃষ্টান্ত, যেখানে কেবল ভ্রমণের আগ্রহই কেড়ে নিল বহু মূল্যবান জীবন।
মৌলবাদ: উগ্র চিন্তার অন্ধকার জগৎ মৌলবাদ হলো এক ধরনের অনমনীয় ও উগ্র মানসিকতা, যেখানে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী তাদের নিজস্ব বিশ্বাসকে একমাত্র সত্য এবং অপরিবর্তনীয় বলে মনে করে। এই ধরনের চিন্তাভাবনা অন্যান্য মতবাদ বা বিশ্বাসকে কেবল উপেক্ষা করে না, বরং প্রায়শই সেগুলোকে নির্মূল করার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে। মৌলবাদী ধ্যানধারণা সমাজে কেবল অস্থিরতা ও বিভেদই সৃষ্টি করে না, বরং গণতান্ত্রিক ও বহুত্ববাদী রাষ্ট্রকাঠামোর জন্যও একটি বড় বিপদ। পেহেলগামের ঘটনা আবারও প্রমাণ করে যে, মৌলবাদী চিন্তা কতটা ভয়ংকর রূপ নিতে পারে।
মৌলবাদ একটি সমাজের অভ্যন্তরীণ কাঠামোকে দুর্বল করে দেয়। এটি জ্ঞানচর্চা, সংস্কৃতি এবং সহিষ্ণুতার স্বাভাবিক পরিবেশকে ধ্বংস করে ফেলে। এমন একটি ভবিষ্যৎ আমরা কেউই কামনা করি না, যেখানে ভিন্নমত পোষণকারীদের নির্বিচারে হত্যা করা হয় এবং মানবতার পক্ষে কথা বললেই শত্রু হিসেবে চিহ্নিত হতে হয়।
জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদের উৎস: গভীরে প্রোথিত কারণ জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদের উত্থানের পেছনে একাধিক জটিল কারণ বিদ্যমান। এর মধ্যে অন্যতম হলো:
রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, নিপীড়ন এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য অনেক সময় হতাশা ও ক্ষোভের জন্ম দেয়, যা উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলো সহজেই কাজে লাগাতে পারে। প্রান্তিক ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে ভুল পথে চালিত করা তাদের জন্য সহজ হয়।
সামাজিক অবিচার ও বঞ্চনা সমাজে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা অবিচার, জাতিগত বা ধর্মীয় বৈষম্য অনেক মানুষকে হতাশ করে তোলে। এই হতাশা উগ্রবাদী মতাদর্শের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার একটি কারণ হতে পারে।
শিক্ষা ও সচেতনতার অভাব শিক্ষার অভাব এবং সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনার বিকাশে বাধা জঙ্গিবাদী ও মৌলবাদী প্রচারণার শিকার হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়। ভুল তথ্য ও বিদ্বেষপূর্ণ বয়ান সহজেই সরল বিশ্বাসী মানুষের মন দখল করে নেয়।
আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ ও ভূ-রাজনৈতিক কারণ বিভিন্ন অঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদী সংঘাত, বিদেশি শক্তির হস্তক্ষেপ এবং ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলোর উত্থান ও বিস্তারে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
ধর্মের অপব্যাখ্যা জঙ্গিবাদী ও মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলো প্রায়শই ধর্মীয় গ্রন্থ ও অনুশাসনকে নিজেদের সংকীর্ণ ও সহিংস এজেন্ডা বাস্তবায়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। তারা ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে অনুসারীদের বিভ্রান্ত করে এবং সহিংস কার্যক্রমে উৎসাহিত করে।
কঠোর ব্যবস্থা ও শান্তির অন্বেষণ: দ্বিমুখী পথ জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদ নির্মূলের জন্য কেবল কঠোর আইন প্রয়োগ যথেষ্ট নয়, এর পাশাপাশি প্রয়োজন সামগ্রিক ও দীর্ঘমেয়াদী কৌশল।
কঠোর আইন প্রয়োগ ও নিরাপত্তা জোরদারকরণ সন্ত্রাসী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রকে কঠোর অবস্থান নিতে হবে। সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর অর্থায়ন, প্রশিক্ষণ এবং নেটওয়ার্ক ভেঙে দিতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অপরিহার্য।
শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধি তরুণ প্রজন্মকে মৌলবাদী চিন্তার বিষ থেকে রক্ষা করার জন্য শিক্ষার মাধ্যমে তাদের মধ্যে যুক্তিবাদী, সমালোচনামূলক ও মানবিক চিন্তাভাবনার বিকাশ ঘটাতে হবে।
সামাজিক ন্যায়বিচার ও বৈষম্য হ্রাস সমাজে বিদ্যমান অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য দূর করতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
আন্তঃধর্মীয় সংলাপ ও সাংস্কৃতিক বিনিময় বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া ও শ্রদ্ধাবোধ বৃদ্ধির জন্য নিয়মিত সংলাপ ও সাংস্কৃতিক বিনিময় কর্মসূচি আয়োজন করা প্রয়োজন।
গণমাধ্যমের ভূমিকা গণমাধ্যমকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। উস্কানিমূলক খবর প্রচারের পরিবর্তে শান্তি, সহিষ্ণুতা ও ঐক্যের বার্তা ছড়িয়ে দিতে হবে।
মানবিক পৃথিবীর আহ্বান: সম্মিলিত প্রচেষ্টার বিকল্প নেই আজ আমরা এক কঠিন সময়ের মুখোমুখি। মানবিক মূল্যবোধ আজ হুমকির মুখে। পেহেলগামের হামলা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, যতক্ষণ না আমরা একে অপরের প্রতি সহানুভূতি, সহিষ্ণুতা ও ভালোবাসা প্রদর্শন করতে পারব, ততক্ষণ পর্যন্ত এই পৃথিবীতে কারও জীবন নিরাপদ নয়।
আমাদের এমন একটি পৃথিবী প্রয়োজন, যেখানে বিভেদের পরিবর্তে ঐক্য বিরাজ করবে, যেখানে কোনো শিশু বোমার আঘাতে প্রাণ হারাবে না এবং কোনো পর্যটককে কেবল ভ্রমণের জন্য জীবন দিতে হবে না।
আজকের দিনে আমাদের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করতে হবে যে, আমরা সম্মিলিতভাবে জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাব। আমাদের রাষ্ট্র, সমাজ এবং প্রতিটি মানুষকে ঐক্যবদ্ধভাবে একটি মানবিক বিশ্ব গড়ে তোলার জন্য কাজ করতে হবে।
মন্তব্য করুন