ঢাকা মঙ্গলবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১ পৌষ ১৪৩২
মুক্ত মনমুক্ত চিন্তামুক্তি গাথা
শহীদ বুদ্ধিজীবী

নিবারণচন্দ্র সাহা

প্রিয়ভূমি ডেস্ক
প্রকাশ : ১১ মে ২০২৫, ০৭:৫৪ পিএম
নিবারণচন্দ্র সাহা

নিবারণচন্দ্র সাহা ছিলেন শিক্ষক ও খ্যাতিমান হোমিও চিকিৎসক। আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। মানিকগঞ্জের শিবালয় এলাকার প্রভাবশালী ও সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তি হিসেবে তিনি স্থানীয় রাজনীতি ও সামাজিক কাজে নেতৃত্ব দিতেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিলেন সোচ্চার। স্থানীয় হিন্দুদের প্রতি রাজাকার ও পাকিস্তানি হানাদারদের আক্রোশ ছিল বেশি। এ কারণে হানাদার সেনারা তাঁকে গুলি করে হত্যা করে।

মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার অন্বয়পুর গ্রামে ১৯০৮ সালে নিবারণচন্দ্র সাহা জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মুকুন্দলাল সাহা ছিলেন ব্যবসায়ী ও প্রচুর ভূসম্পত্তির অধিকারী। মা মানদা সাহা গৃহিণী। নিবারণ স্থানীয় তেওতা একাডেমিতে পড়াশোনা করেন। পরে গুরু ট্রেনিং স্কুল থেকে জিটি (গুরু ট্রেনিং) পাস করে স্থানীয় পুকুরচালা স্কুলে শিক্ষক পদে যোগ দেন। বছর দশেক শিক্ষকতার পর তিনি হোমিওপ্যাথিতে এইচএমবি কোর্স সম্পন্ন করে চিকিৎসাকে পেশা হিসেবে নেন।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মানিকগঞ্জের বিপ্লবী পরিষদের নির্দেশে আরিচা-গোয়ালন্দ ফেরিঘাটের সব ফেরি এক মাইল দক্ষিণের ভাটি অঞ্চলে সরিয়ে ফেলা হয়। উদ্দেশ্য ছিল, ঢাকা থেকে হানাদার সেনারা যেন নির্বিঘ্নে ফেরি পার হয়ে উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গে যেতে না পারে। একাত্তরের ৮ এপ্রিল বর্বর হানাদার সেনারা আকাশ ও সড়কপথে মানিকগঞ্জ আসে। তারা আরিচা ঘাটে ক্যাম্প করে জাবরা, তরা ও বানিয়াজুরী এলাকায় হত্যা, লুটপাট, ধর্ষণ ও বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে জনমনে আতঙ্ক ছড়ায়। এপ্রিলের শুরুতে নিবারণচন্দ্র সাহা স্ত্রী ও পরিবারের সবাইকে পাশের রূপসা গ্রামে পাঠিয়ে দেন।

তিনি দিনে বাড়িতে থাকলেও রাতে অন্য স্থানে আত্মগোপন করে থাকতেন। একাত্তরের ২১ এপ্রিল সন্ধ্যায় আরিচা ঘাট থেকে গানবোটে করে একদল সশস্ত্র পাকিস্তানি সেনা অন্বয়পুর গ্রামে ঢোকে। তারা হেমগঞ্জ বাজার ও অন্বয়পুর গ্রামে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। ঘাতক সেনাদের আচমকা হামলায় গ্রামবাসী ছোটাছুটি করে ঝোপ-ঝাড় ও পরিত্যক্ত ভিটায় গিয়ে আত্মগোপন করেন। এমন অবস্থায় ষাটোর্ধ্ব শিক্ষক ও হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক নিবারণ সাহাকে অন্বয়পুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পেছনে চার রাস্তার মোড়ে আটক করে ঘাতক সেনারা। সেখানেই তাঁর বুক গুলিতে ঝাঁজরা করে দেয় তারা। খুনির দল চলে গেলে রাস্তার পাশে পড়ে থাকা নিবারণ সাহার লাশ স্থানীয় বাসিন্দারা রূপসা গ্রামে তাঁর পরিবারের কাছে নিয়ে যান। পরের দিন রূপসাতেই নিবারণ সাহার সৎকার করা হয়।

শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে তথ্য চেয়ে বিজ্ঞাপন ছাপা হলে মানিকগঞ্জ সদরের খাবাশপুর আদর্শ ডিগ্রি কলেজের বাংলার প্রভাষক এবং জেলা মুক্তিযুদ্ধ পাঠ ও গবেষণা পরিষদের সদস্য সচিব মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর নিবারণচন্দ্র সাহার ছবি ও তথ্য পাঠান। মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের নিয়ে তাঁর মাঠপর্যায়ে গবেষণার তথ্য নিয়ে প্রকাশিত স্মৃতি ও শ্রুতিতে মানিকগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধ বইতে শহীদ নিবারণচন্দ্র সাহার জীবনী রয়েছে। এ ছাড়া মুহাম্মদ আবদুল বাতেনের ইতিহাস ঐতিহ্যে মানিকগঞ্জ এবং সম্প্রতি এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত ড. হারুন-অর-রশিদ সম্পাদিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ বইতে শহীদ নিবারণ সাহার জীবন ও শহীদ হওয়ার তথ্য রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে নির্মিত শিবালয় উপজেলার তেওতা ইউনিয়ন পরিষদসংলগ্ন স্মৃতিফলকে নিবারণচন্দ্র সাহার নাম রয়েছে।

নিবারণ চন্দ্র সাহার স্ত্রী লক্ষ্মী রানী সাহা ছিলেন গৃহিণী। ২০১৩ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁদের দুই ছেলে ও সাত মেয়ে। ছেলে নিলিমেশচন্দ্র সাহা ও নিগিমেশচন্দ্র সাহা বাবার মতো চিকিৎসা পেশাকেই বেছে নিয়েছেন। বড় ছেলে নিলিমেশচন্দ্র সাহা জানান, তাঁদের বাবার আকস্মিক মৃত্যুতে পরিবারে বিপর্যয় নেমে আসে। দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর মাকে সমবেদনা জানিয়ে একটি শোকবার্তা ও দুই হাজার টাকার অনুদান পাঠিয়েছিলেন। এ ছাড়া তাঁরা সরকারি কোনো সহায়তা পাননি। স্বাধীনতার ৫০ বছরেও তাঁর বাবা শহীদের স্বীকৃতি পাননি, এটা তাঁদের কাছে বড় বেদনাদায়ক হয়ে আছে।

প্রথম প্রকাশ : প্রথম আলো

অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মহান বিজয় দিবস: গৌরবের দিনে প্রশ্নের ছায়া

১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ের এক ঘটনাবহুল দিন

পরের নোবেলটি কার? ইউনুস না শফিক?

এই পতাকা কাদের? / কে চেয়েছে এই পতাকা???

এখন আমাদের ত্রাণকর্তা কে? / ইউনুস, ডোভাল না রজার???

৪ অক্টোবর ১৯৭১: বিনা শর্তে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবি মধ্যপ্রদেশের বিধানসভায়

১ অক্টোবর ১৯৭১: রায়পুরের রাজাকার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গেরিলাদের আক্রমণ

হাসনাবাদ গণহত্যা (নবাবগঞ্জ, ঢাকা)

কাটেঙ্গা গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: ‘পূর্ব বাংলার সমস্যার সমাধান শেখ মুজিবের সঙ্গেই করতে হবে’

১০

২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: “বিদেশি চাপে আমাদের বহু চেষ্টা নস্যাত হয়ে গেছে”

১১

২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: জাতিসংঘে বাংলাদেশ নিয়ে নাটকীয়তা

১২

সাদকপুর গণহত্যা (বুড়িচং, কুমিল্লা)

১৩

ফুলদহেরপাড়া গণহত্যা (সরিষাবাড়ী, জামালপুর)

১৪

আন্দুলিয়া গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

১৫

২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বিজয়ই আমাদের একমাত্র ও চূড়ান্ত গন্তব্য

১৬

জুলাই অভ্যুত্থানের প্রতারণা: জনগণের অট্টহাসি ও অবিশ্বাসের প্রতিফলন

১৭

২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: চালনা বন্দরে মার্কিন জাহাজ মাইন বিস্ফোরণে ধ্বংস

১৮

বীর উত্তম আবদুস সালেক চৌধুরী: আকাশছোঁয়া হয়ে উঠেছিল যাঁর সাহস

১৯

রামনগর গণহত্যা (রায়পুরা, নরসিংদী)

২০