ঢাকা মঙ্গলবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১ পৌষ ১৪৩২
মুক্ত মনমুক্ত চিন্তামুক্তি গাথা
শহীদ বুদ্ধিজীবী

হিতেন্দ্রনাথ চন্দ

প্রিয়ভূমি ডেস্ক
প্রকাশ : ১১ মে ২০২৫, ০৭:৫১ পিএম
হিতেন্দ্রনাথ চন্দ

গভীর দেশপ্রেম ছিল শিক্ষক হিতেন্দ্রনাথ চন্দের। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করতেন। সে কারণেই সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের জনপ্রিয় এই শিক্ষককে রাজাকাররা গভীর রাতে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। ঘটনাটি ঘটেছিল একাত্তরের ১ সেপ্টেম্বর।

শহীদ হিতেন্দ্রনাথ চন্দের বড় ছেলে সমন্বিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) অবসরপ্রাপ্ত জেলা সুপারিনটেনডেন্ট পুলকেন্দ্রনাথ চন্দ সেদিনের স্মৃতিচারণা করে প্রথম আলোকে জানান, রাত প্রায় তিনটার দিকে স্থানীয় কুখ্যাত রাজাকার কোরবান আলীর সহযোগীরা তাঁদের বাড়ির সামনে এসে দু-তিনটি ফাঁকা গুলি করে। এরপর তারা বাড়ির দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়ে। তার বাবাকে জানায়, কোরবান আলী ডেকেছে। তাদের সঙ্গে যেতে হবে।

তাঁর মা অনেক কান্নাকাটি করেন। টাকা-গয়না নিয়ে ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করেন। কিন্তু ঘাতক রাজাকারের দল কোনো কথা না শুনে তার বাবাকে টেনেহিঁচড়ে ঘর থেকে তুলে নিয়ে যায়। এর খানিক পরই তাঁরা পর পর দুটি গুলির শব্দ শুনতে পান। পরদিন সকালে তাঁরা বাড়ি থেকে কিছু দূরে শাহজাদপুর কৌজুরী সড়কের পাশে বাবার গুলিবিদ্ধ লাশ দেখতে পান। তখন ছিল বর্ষাকাল। পরিস্থিতিও অনুকূল ছিল না। তাই শব দাহ করা সম্ভব হয়নি। ধর্মীয় বিধিমতে কোনোরকমে মুখাগ্নি করে নদীর স্রোতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। তিনি বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও বাবা শহীদ বুদ্ধিজীবীর সরকারি স্বীকৃতি পাননি। গ্রামের ৩১ শতক পৈতৃক ভিটা এখনো অন্যের দখলে।

রশীদ হায়দার সম্পাদিত বাংলা একাডেমির স্মৃতি: ১৯৭১এর পুনর্বিন্যাসকৃত দ্বিতীয় খণ্ডে শহীদ হিতেন্দ্রনাথ চন্দকে নিয়ে তাঁর ছেলে অশোককুমার চন্দের একটি লেখা রয়েছে। এ ছাড়া ড. মুহম্মদ আবদুল জলিলের শাহজাদপুরের ইতিহাস বইতে শহীদ বুদ্ধিজীবী হিতেন্দ্রনাথ চন্দের সংক্ষিপ্ত জীবনী রয়েছে।

হিতেন্দ্রনাথ চন্দের জন্ম ১৯৩৬ সালের ১৪ জুলাই তৎকালীন সিরাজগঞ্জ মহকুমার শাহজাদপুর থানার পুঠিয়া গ্রামে। তিনি ১৯৫৭ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে স্নাতক ডিগ্রি নেন। কলকাতায় অনেক লোভনীয় চাকরির সুযোগ ছেড়ে শিক্ষক বাবার আদর্শে অনুপ্রাণিত হিতেন্দ্রনাথ চন্দ ১৯৫৮ সালে সিরাজগঞ্জের বেলকুচির দৌলতপুর উচ্চবিদ্যালয়ে শিক্ষকতা দিয়ে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। পরে তিনি শাহজাদপুরে খুকনী উচ্চবিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। শহীদ হওয়ার আগপর্যন্ত এখানেই কর্মরত ছিলেন তিনি।

শহীদ হিতেন্দ্রনাথ সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলে যুক্ত ছিলেন না। তিনি ছিলেন স্বাধিকার ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে তিনি তাতে সমর্থন করেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তরুণদের তিনি যুদ্ধে অংশ নিতে অনুপ্রাণিত করতেন। এ কারণে রাজাকাররা তাঁর ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।

শহীদ হিতেন্দ্রনাথ চন্দের স্মৃতিচারণা করে আজাদ রহমান বলেন, তিনি ছিলেন স্বাধীনতাকামী একজন জনপ্রিয় শিক্ষক। এলাকার কুখ্যাত রাজাকার কোরবান আলীর ভাই দলবল নিয়ে বাড়ি থেকে তাঁকে তুলে নিয়ে হত্যা করে।

শহীদ হিতেন্দ্রনাথ চন্দের স্ত্রী অপর্ণা চন্দ বেঁচে আছেন। বয়স প্রায় ৯৫ বছর। তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সমবেদনা জানিয়ে তাঁর কাছে একটি চিঠি ও দুই হাজার টাকা অনুদান দিয়েছিলেন। কিন্তু টাকা পাওয়ার পরপরই বাড়িতে ডাকাতেরা হামলা করে। সেই টাকাসহ তাঁর গয়না ও সব মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে যায়। জমি দখল করে নেয়। বহু কষ্টে তিনি দুই ছেলে ও পাঁচ মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়ে বড় করেছেন। কোনো সাহায্যসহযোগিতা পাননি। এমনকি তাঁর স্বামী শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে সরকারি স্বীকৃতিও পাননি। মৃত্যুর আগে যদি তিনি দেখে যেতে পারেন স্বামী শহীদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পেলেন, তবে এটাই হবে তাঁর বড় সান্ত্বনা।

প্রথম প্রকাশ : প্রথম আলো

অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মহান বিজয় দিবস: গৌরবের দিনে প্রশ্নের ছায়া

১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ের এক ঘটনাবহুল দিন

পরের নোবেলটি কার? ইউনুস না শফিক?

এই পতাকা কাদের? / কে চেয়েছে এই পতাকা???

এখন আমাদের ত্রাণকর্তা কে? / ইউনুস, ডোভাল না রজার???

৪ অক্টোবর ১৯৭১: বিনা শর্তে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবি মধ্যপ্রদেশের বিধানসভায়

১ অক্টোবর ১৯৭১: রায়পুরের রাজাকার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গেরিলাদের আক্রমণ

হাসনাবাদ গণহত্যা (নবাবগঞ্জ, ঢাকা)

কাটেঙ্গা গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: ‘পূর্ব বাংলার সমস্যার সমাধান শেখ মুজিবের সঙ্গেই করতে হবে’

১০

২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: “বিদেশি চাপে আমাদের বহু চেষ্টা নস্যাত হয়ে গেছে”

১১

২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: জাতিসংঘে বাংলাদেশ নিয়ে নাটকীয়তা

১২

সাদকপুর গণহত্যা (বুড়িচং, কুমিল্লা)

১৩

ফুলদহেরপাড়া গণহত্যা (সরিষাবাড়ী, জামালপুর)

১৪

আন্দুলিয়া গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

১৫

২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বিজয়ই আমাদের একমাত্র ও চূড়ান্ত গন্তব্য

১৬

জুলাই অভ্যুত্থানের প্রতারণা: জনগণের অট্টহাসি ও অবিশ্বাসের প্রতিফলন

১৭

২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: চালনা বন্দরে মার্কিন জাহাজ মাইন বিস্ফোরণে ধ্বংস

১৮

বীর উত্তম আবদুস সালেক চৌধুরী: আকাশছোঁয়া হয়ে উঠেছিল যাঁর সাহস

১৯

রামনগর গণহত্যা (রায়পুরা, নরসিংদী)

২০