

বাড়িতে দুপুরে গোসল করছিলেন চিকিৎসক এস এম ইয়াকুব। সৈয়দপুর সেনানিবাস থেকে আসা একদল পাকিস্তানি হানাদার সেনা সেই অবস্থায় ভেজা শরীরেই তাঁকে তুলে নিয়ে যায়। আর ফিরে আসেননি তিনি। সেদিন ছিল একাত্তরের ২৭ মার্চ। কথাগুলো বলছিলেন এস এম ইয়াকুবের ছোট মেয়ে ইশরাত জাহান।
ইশরাত জাহান এখন ঢাকার মিরপুরে বসবাস করেন। মুঠোফোনে ইশরাত বলেন, ‘আমার বাবা ছিলেন একজন প্রতিবাদী মানুষ। এ ছাড়া তিনি একজন নাট্যামোদী ছিলেন। ভালো গান লিখতেন, সুরও করতেন নিজেই।’
এস এম ইয়াকুবের জন্ম ১৯১৬ সালে পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলায়। বাবার নাম শোয়েব আলী, মা মালেকা বেগম। তিনি কলকাতার বউবাজারে অবস্থিত বেঙ্গল অ্যালেন্ট হোমিওপ্যাথি মেডিকেল কলেজ থেকে ডিএমএস ডিগ্রি অর্জন করেন। তরুণ বয়সে তিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।
পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে এর প্রতিবাদে রুখে দাঁড়ান এস এম ইয়াকুব। এ কারণে উগ্রপন্থীদের রোষানলে পড়তে হয় তাঁকে। ফলে দেশ বিভাগের আগেই কলকাতা থেকে তৎকালীন রংপুর জেলার রেলওয়ে জনপদ সৈয়দপুরে চলে আসেন সপরিবার। দেশ বিভাগের পর ১৯৫২ সালে এস এম ইয়াকুবের মা-বাবা কলকাতায় ফিরে যান। কিন্তু এ দেশকে ভালোবেসে এস এম ইয়াকুব ও তাঁর স্ত্রী উম্মে কুলছুম সৈয়দপুরে থেকে যান। সৈয়দপুর শহরে নতুন বাবুপাড়ায় স্ত্রীর নামে ‘কুলছুম বাসভবন’ তৈরি করেন। এখানেই বসবাস করছিল চিকিৎসক এস এম ইয়াকুবের পরিবার। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৮ সালে ২ এপ্রিল শহীদজায়া উম্মে কুলছুম মৃত্যুবরণ করেন। শহীদ ইয়াকুবের দুই ছেলে, চার মেয়ে। তাঁদের মধ্যে বড় দুই মেয়েও মারা গেছেন।
শহীদ চিকিৎসক এস এম ইয়াকুব ছিলেন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) সৈয়দপুর থানা কমিটির সভাপতি। পার্টির কর্ণধার মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বহুবার এসেছেন কুলছুম বাস ভবনে। পাকিস্তান আমলে রংপুর অঞ্চলে ন্যাপের যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালিত হতো তাঁর বাড়ি থেকেই।
এস এম ইয়াকুবের তৃতীয় মেয়ে ইফফাত জাহান অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। তিনি উদীচী সৈয়দপুর শাখার একজন সক্রিয় সদস্য। বাবার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বলেন, ‘বাবা ছিলেন সংস্কৃতিমনা মানুষ। সৈয়দপুরে আমাদের বাড়িতেই বাবা প্রথম পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। ‘এসো হে বৈশাখ’ গানে মুখর হতো পুরো এলাকা। সৈয়দপুরের সর্বস্তরের রাজনীতিবিদ আমাদের বাড়িতে বৈশাখী অনুষ্ঠানে যোগ দিতেন।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের পর সৈয়দপুরের পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। হানাদার সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় স্থানীয় বিহারিরা শহরজুড়ে শুরু করে তাণ্ডব। এ সময় এস এম ইয়াকুব সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে মিলে যুগপৎ আন্দোলনে অংশ নেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে অবাঙালিরা। খুনির দল তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা করে। বিহারিদের সহায়তায় হানাদার সেনারা ২৭ মার্চ গোসল করা অবস্থায় এস এম ইয়াকুবকে তাঁর বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে সৈয়দপুর সেনানিবাসের কোয়ার্টার গার্ডে বন্দী রেখে অকথ্য নির্যাতন করে। পরে সৈয়দপুরের অন্য নেতাদের সঙ্গে ১২ এপ্রিল রংপুর সেনানিবাস এলাকার নিসবেতগঞ্জ বধ্যভূমিতে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে।
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চিঠি দিয়ে সমবেদনা জানিয়েছিলেন এস এম ইয়াকুবের পরিবারকে। মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীও পরিবারটির খোঁজখবর রাখতেন। রংপুর গবেষণা পরিষদের প্রকাশনা মুক্তিযুদ্ধে রংপুর গ্রন্থে শহীদ চিকিৎসক এস এম ইয়াকুবের সংক্ষিপ্ত জীবনী রয়েছে। সৈয়দপুর শহরে জিআরপি মোড়ে অবস্থিত স্মৃতি অম্লানে শহীদের তালিকায় তাঁর নাম উৎকীর্ণ করা হয়েছে। শহরে একটি সড়কের নামকরণও করা হয়েছে শহীদ এস এম ইয়াকুবের নামে।
প্রথম প্রকাশ : প্রথম আলো
মন্তব্য করুন