‘চুরি, ছিনতাই, ডাকাতির জন্য ভাড়ায় মিলছে চাপাতি ও মোটরসাইকেল’—এই শিরোনামে ২০ জুলাই ইন্ডিপেন্ডেন্ট পত্রিকায় প্রকাশিত একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন আমাদের ভয়াবহ এক বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। সংবাদের ভাষায়—অপরাধ কর্মের জন্য ছিনতাইকারীরা চাপাতি ও মোটরসাইকেল ভাড়া নিচ্ছে, আর ছিনতাই শেষে মাল বিক্রি করে সেই ভাড়া পরিশোধ করছে। যেন একটি বৈধ সেবাখাত, কেবল পার্থক্য—এর পণ্য সন্ত্রাস, ভীতি আর রক্ত।
তদন্তে উঠে এসেছে, ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় এই অপরাধের জন্য সরঞ্জাম ও সরলতা সরবরাহ করে একটি সংঘবদ্ধ চক্র। এমনকি পুলিশের হাতে ধরা পড়া অপরাধীদের জামিনের ব্যবস্থাও করে দিচ্ছে চক্রটি। ছিনতাইকারীরা একবার বেরিয়ে এসে আবারও অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। বারবার। আবারও।
অপরাধের নতুন ‘সাপ্লাই চেইন’
এই চক্রের মূল হোতা কবির নামের এক ব্যক্তি, যার কাছ থেকেই পাওয়া যায় চাপাতি ও মোটরসাইকেল। আরও ভয়াবহ ব্যাপার হলো, আগাম টাকা ছাড়াই এই ভাড়া পাওয়া যাচ্ছে—যা বলে দেয়, এটি স্রেফ খুচরা অপরাধ নয়, বরং পরিকল্পিত ‘ক্রাইম ইকোনমি’র অংশ। চক্রটি শুধু সরঞ্জাম সরবরাহ করে না, বরং ছিনতাইয়ে পাওয়া মূল্যবান জিনিস নিজেরাই কিনে নেয়, আবার জামিনের পর পুনরায় কাজে লাগায় অপরাধীদের।
একটি পেশাদার ব্যবসার মতোই চলে এই অপরাধব্যবস্থা। অস্ত্র ভাড়া, যানবাহন ভাড়া, মাল বিক্রির চ্যানেল, আইনি সহায়তা—সব মিলিয়ে একটি “সম্পূর্ণ সেবা প্যাকেজ”। এটি আধুনিক অপরাধপ্রবণতার এক নগ্ন প্রতিচ্ছবি।
রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার মুখোশ উন্মোচন
ঢাকা মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার মোহাম্মদ রাকিব খান ও যুগ্ম কমিশনার নাসিরুল ইসলাম সংবাদে স্বীকার করেছেন, এবারই প্রথম এমন ‘ভাড়ায় অস্ত্র সরবরাহ’ সম্পর্কে নিশ্চিত তথ্য উঠে এসেছে। কিন্তু এই ‘প্রথমবার’ বলাটা কি রাষ্ট্রের দায় এড়ানোর একটি কৌশল নয়? এতদিন এরা কোথায় ছিল? যদি সমাজে ‘অপরাধের জন্য ভাড়া দেওয়া সরঞ্জাম’ চালু হয়ে থাকে, তাহলে তা গড়ে উঠেছে নিঃসন্দেহে এক দীর্ঘ সময়ের পেছনে পুলিশি নীরবতা বা ব্যর্থতার ছায়ায়।
অপরাধ বিশ্লেষক ড. তৌহিদুল হক যথার্থই বলেছেন, “অপরাধ সৃষ্টির জন্য, অপরাধী সৃষ্টির জন্য যদি বিনিয়োগ হয়, তাহলে বুঝতে হবে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে অবনতির দিকে যাচ্ছে।” এই অবনতির মূলে শুধু অপরাধীর বেপরোয়া মনোভাব নয়, রয়েছে রাষ্ট্রযন্ত্রের দুর্বলতা ও রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তির অভাব।
সামাজিক ও অর্থনৈতিক পটভূমি
আমাদের সমাজে বেকারত্ব, বৈষম্য, আয়হীনতা, মাদক বিস্তার এবং রাজনৈতিক নিপীড়ন—সব মিলিয়ে একটি বিস্ফোরণযোগ্য পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এর মাঝে অপরাধ আজ আর ক্ষণিকের বিপথগামিতায় সীমাবদ্ধ নেই; বরং সেটি পরিণত হয়েছে বাঁচার এক বিকল্প অর্থনৈতিক কৌশলে। যারা এসব কর্মকাণ্ডে জড়াচ্ছে, তাদের অনেকেই পূর্বে শিক্ষার্থী, শ্রমিক, অথবা হতাশ নাগরিক—যারা হয়ত চেষ্টা করেছিল, কিন্তু রাষ্ট্র বা সমাজ তাদের সামনে বিকল্প কোনো পথ খুলে দেয়নি।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিচারব্যবস্থা: নাকি ‘রিসাইক্লিং মেশিন’?
বর্তমান ব্যবস্থায় অপরাধী ধরা পড়ছে, জামিনে বের হচ্ছে, আবার ছিনতাই করছে—এ যেন অপরাধীদের ‘রিসাইক্লিং মেশিন’। পুলিশ গ্রেপ্তার করে, আদালত জামিন দেয়, চক্র ফেরত আনে। এই চক্রে কেউ আইন ভাঙছে, আবার কেউ তা দেখে নিশ্চুপ থেকেও অপরাধের অংশীদার হচ্ছে।
নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের দায়
মিডিয়ায় একদিনের হেডলাইন হয়ে থাকা, ফেসবুকে কয়েকটি শেয়ার আর তুচ্ছ কিছু ক্ষোভ—এই দিয়ে কোনো জাতি অপরাধ প্রতিরোধ করতে পারে না। প্রয়োজন সোচ্চার নাগরিক অবস্থান, সমাজে সচেতনতা, এবং ধারাবাহিক বিশ্লেষণ। গণমাধ্যমকে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ধারায় বারবার এসব বিষয় তুলে আনতে হবে। নীরবতা মানেই পরোক্ষ সহমত।
করণীয় ও সুপারিশ
গোড়ায় কুঠারাঘাত করতে হবে: ‘ভাড়ায় অস্ত্র সরবরাহকারী চক্র’ চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে জঙ্গি দমন আইনের আদলে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
অপরাধীদের অর্থনৈতিক উৎস অনুসন্ধান: এই চক্র কাদের ছত্রছায়ায় চলে, তাদের রাজনৈতিক/প্রশাসনিক আশ্রয় কোথায়, তা খুঁজে বের করে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে।
ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার সংস্কার: জামিনের সুযোগের অপব্যবহার রোধে আইনি সংস্কার এবং পেশাদার অপরাধীদের জন্য বিশেষ ট্র্যাকিং ব্যবস্থা চালু করা জরুরি।
সামাজিক বিনিয়োগ: তরুণদের কর্মসংস্থান, মানসিক স্বাস্থ্য, মাদকমুক্ত সমাজ গড়ার উদ্যোগ—এসবকে প্রাধান্য দিয়ে সরকারকে বাজেটে নতুন মাত্রা সংযোজন করতে হবে।
অপরাধ পরবর্তী পুনর্বাসন: যারা অপরাধ থেকে সরে আসতে চায়, তাদের জন্য বিকল্প জীবিকা ও কাউন্সেলিংসহ সমাজে পুনঃস্থাপন কার্যক্রম চালু করতে হবে।
‘চাপাতি ও মোটরসাইকেল ভাড়ায় পাওয়া যায়’—এমন একটি বাক্য শুধু কোনো সংবাদ নয়, বরং রাষ্ট্রব্যবস্থার উপর একটি অভিযোগপত্র। এটি রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণহীনতা, সমাজিক অবক্ষয় এবং প্রশাসনিক অকার্যকারিতার প্রতীক। এমন দিনে দাঁড়িয়ে, আমাদের নীরব থাকা মানে হবে অপরাধীদের হাতে আরেকটি চাপাতি তুলে দেওয়া।
সময়ের দাবি হলো—রাষ্ট্র যেন চোখ মেলে দেখে, সমাজ যেন মুখ খুলে বলে, এবং প্রতিটি নাগরিক যেন সচেতন হয়। অপরাধ কোনো দুর্ঘটনা নয়—এটি প্রতিরোধযোগ্য, যদি আমরা সকলে মিলে চাই।
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক
মন্তব্য করুন