সম্প্রতি চট্টগ্রামে দুই ব্যক্তির শরীরে জিকা ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে, এই সংবাদ দেশের জনস্বাস্থ্য নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি করেছে। ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার মতোই জিকা ভাইরাসও এডিস মশার মাধ্যমে ছড়ায় এবং এটি আগামী দিনে আরেকটি বড় স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পরিণত হতে পারে।
চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা যায়, দুজন রোগীর শরীরে বেসরকারি ল্যাব এপিক হেলথ কেয়ারে পরীক্ষার মাধ্যমে জিকা ভাইরাস শনাক্ত হয়। আক্রান্তদের মধ্যে একজন নারী ও একজন পুরুষ, দুজনেরই বয়স ৪০ বছরের ঊর্ধ্বে।
যদিও এখনো আইইডিসিআর থেকে নিশ্চিত কোনো বিবৃতি আসেনি, তবে স্থানীয় স্বাস্থ্য বিভাগ বিষয়টি গুরুত্বসহকারে নিয়েছে এবং প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিচ্ছে। জিকা একটি ভাইরাসজনিত রোগ, যা মূলত এডিস মশার মাধ্যমে ছড়ায়। ভাইরাসটি প্রথম ১৯৪৭ সালে উগান্ডার ‘জিকা বন’-এ শনাক্ত হয়েছিল, সেখান থেকেই এর নামকরণ। এটি ফ্লাভিভাইরাস গোত্রের অন্তর্ভুক্ত।
সাধারণত এই ভাইরাসটি হালকা উপসর্গ তৈরি করে এবং অনেক ক্ষেত্রেই উপসর্গহীন অবস্থায় থেকে যায়। তবে বিশেষত গর্ভবতী নারীর ক্ষেত্রে এটি গুরুতর প্রভাব ফেলতে পারে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই উপসর্গগুলোর মধ্যে দেখা যায়, হালকা জ্বর, ত্বকে র্যাশ বা ফুসকুড়ি, মাথা ব্যথা, চোখ লাল হওয়া (কনজাংকটিভাইটিস), অস্থিসন্ধি ও মাংসপেশির ব্যথা। সাধারণত এই উপসর্গগুলো দুই থেকে সাত দিন স্থায়ী হয়।
তবে গর্ভবতী নারীদের মধ্যে জিকা সংক্রমিত হলে নবজাতকের মধ্যে মাইক্রোসেফালি (মস্তিষ্ক অসম্পূর্ণভাবে গঠিত হওয়া) ও অন্যান্য নিউরোডেভেলপমেন্টাল সমস্যার আশঙ্কা দেখা দেয়। এ ছাড়া খুব কম ক্ষেত্রে Guillain-Barré syndrome-এর মতো স্নায়বিক জটিলতা দেখা দিতে পারে।
বর্তমানে বাংলাদেশ ডেঙ্গু এবং কখনো কখনো চিকুনগুনিয়ার ভয়াবহতার মধ্যেই আছে। এর মধ্যে জিকার মতো নতুন ভাইরাসের আবির্ভাব হলে তা একদিকে স্বাস্থ্য খাতে চাপ, অন্যদিকে জনমনে আতঙ্কও বাড়াবে। তা ছাড়া ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও জিকা একই বাহকের মাধ্যমে ছড়ালেও এই তিনটির উপসর্গ আংশিকভাবে মিল থাকায় প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয়ে জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে।
ফলে সঠিক চিকিৎসা বিলম্বিত হয় এবং জটিলতা বাড়তে পারে, বাড়াতে পারে মৃত্যুঝুঁকি। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বাংলাদেশে এখনো জিকা ভাইরাস পরীক্ষার পর্যাপ্ত সুবিধা নেই। যে কয়েকটি ল্যাবে এই পরীক্ষা করা যায়, তা সীমিত এবং ব্যয়বহুলও বটে। ফলে গ্রামীণ বা প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এর বাইরে থেকে যায়। জনস্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে এই পরীক্ষার সুযোগ সুলভ ও সহজলভ্য করা প্রয়োজন।
জিকা ভাইরাস সাধারণত এডিস ইজিপ্টাই ও এডিস অ্যালবোপিক্টাস নামক মশার মাধ্যমে ছড়ায়, যা একই সঙ্গে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া ভাইরাসও বহন করে। এ ছাড়া যৌন সংস্পর্শ, রক্ত সংক্রমণ এবং মায়ের দেহ থেকে গর্ভস্থ শিশুর শরীরে এই ভাইরাস সংক্রমিত হতে পারে। এ কারণে এটি শুধু মশা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ঠেকানো সম্ভব নয়, জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং ব্যক্তিগত আচরণেও পরিবর্তন আনা জরুরি।
তবে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও জিকা এই তিনটি রোগই এডিস মশার মাধ্যমে ছড়ায়। তাই মশার বিস্তার রোধ করাই হবে প্রথম এবং কার্যকর প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ। বিভিন্ন পাত্রে জমা পানি; যেমন—বালতি, ড্রাম, পার্কিং ও বেইসমেন্টে জমা পানি, নির্মাণাধীন ভবনে জমা পানি, ফুলের টব, ডাবের খোসা, ফ্রিজের নিচের ট্রে ইত্যাদি যেখানে পানি জমে, সেসব নিয়মিত পরিষ্কার রাখা প্রয়োজন। শহর ও গ্রাম উভয় এলাকায় এই সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাতে হবে।
জনগণের মধ্যে জিকা ভাইরাস সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, স্কুল, কলেজ ও কমিউনিটি সেন্টারে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন চালানো যেতে পারে। ডেঙ্গু বা চিকুনগুনিয়ার উপসর্গ থাকলেও যেন সন্দেহভাজন রোগীদের জিকা পরীক্ষার পরামর্শ দেওয়া হয়। বিশেষ করে গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে এই সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি।
গর্ভবতী নারীদের মশার কামড় থেকে রক্ষা পেতে মশারি ব্যবহার, পূর্ণাঙ্গ পোশাক পরিধান ও ঘরবাড়ি পরিষ্কার রাখার ব্যাপারে আরো সচেতন হতে হবে। এ ছাড়া জিকা ভাইরাস প্রবণ এলাকায় ভ্রমণ না করাই শ্রেয়। সন্দেহ হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে জিকা শনাক্তকরণ পরীক্ষার সক্ষমতা বাড়াতে হবে। শুধু রাজধানী নয়, বিভাগীয় শহর বা বড় জেলা হাসপাতালেও এই পরীক্ষা সহজলভ্য করতে হবে। করোনাভাইরাস শনাক্তকরণের জন্য বিভিন্ন হাসপাতালে পিসিআর প্রযুক্তি আনা হয়েছিল, যেগুলো জিকা শনাক্তকরণে ব্যবহার করা যেতে পারে।
স্বাস্থ্য গবেষকদের জন্য এখনই সময় জিকা নিয়ে বিশেষ গবেষণা ও নজরদারি চালানোর। ভাইরাসটি স্থানীয়ভাবে ছড়াচ্ছে কি না, তা নির্ধারণ করা দরকার। সংক্রমণের উৎস ও গতিপথ বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। যেসব দেশে জিকা ভাইরাস নিয়ে উল্লেখযোগ্য গবেষণা হয়েছে, সেসব দেশের সঙ্গে তথ্য আদান-প্রদানের ব্যবস্থাও করা যেতে পারে।
জিকা ভাইরাস একটি বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্য সমস্যা হওয়ায় এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থাগুলো; যেমন—WHO, CDC প্রভৃতির সঙ্গে সমন্বয় ও সহযোগিতা গড়ে তুলতে হবে। এদের পরামর্শ অনুযায়ী একটি জাতীয় নির্দেশিকা তৈরি করা যেতে পারে।
জিকা ভাইরাস এখনই বড় কোনো মহামারির রূপ না নিলেও এর উপস্থিতি আগাম সতর্কতা হিসেবে বিবেচনা করা জরুরি। ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়ার অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এখনই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারলে ভবিষ্যতের বড় বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব হবে। জনস্বাস্থ্য রক্ষা করতে হলে শুধু চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মীদের নয়, সাধারণ জনগণকেও সচেতন এবং দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। সমন্বিত উদ্যোগ, গবেষণাভিত্তিক কার্যক্রম এবং নাগরিক সচেতনতা—এই তিনটির সমন্বয়ে আমরা শুধু জিকা নয়, ভবিষ্যতের যেকোনো সংক্রামক রোগের ঝুঁকি মোকাবেলা করতে পারব।
লেখক : কিটতত্ত্ববিদ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ | প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন