সাম্প্রতিক সময়ে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে জনমনে চরম উদ্বেগ ও অস্বস্তি বিরাজ করছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সারা দেশে গড়ে প্রতিদিন ১১ জন মানুষ খুন হয়েছেন—এমন তথ্য উঠে এসেছে পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যানে। এই ছয় মাসে মোট ১,৯৩০টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। প্রতি মাসেই খুনের সংখ্যা বেড়েছে; জানুয়ারিতে ২৯৪, ফেব্রুয়ারিতে ৩০০, মার্চে ৩১৬, এপ্রিলে ৩৩৬, মে মাসে ৩৪১ এবং জুনে সর্বোচ্চ ৩৪৩টি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি খুনের ঘটনা ঘটেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন, ঢাকা রেঞ্জ ও চট্টগ্রাম রেঞ্জ এলাকায়।
সম্প্রতি রাজধানীর মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে প্রকাশ্যে ভাঙারি ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, দিনের আলোয় বহু মানুষের সামনে তাকে পিটিয়ে ও ইট-পাথর দিয়ে আঘাত করে হত্যা করা হয়। এ ধরনের নৃশংসতা দেখে সাধারণ মানুষের মুখে উঠে আসে প্রশ্ন—‘মানুষ এতটা নিষ্ঠুর হয় কীভাবে?’ একইভাবে, খুলনার দৌলতপুরে যুবদল নেতা মাহবুবুর রহমান মোল্লাকে গুলি করে ও পায়ের রগ কেটে হত্যা করা হয়। এসব হত্যাকাণ্ডের পেছনে চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তার ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের বিষয় উঠে এসেছে।
খুনের পাশাপাশি দেশে ডাকাতি, ছিনতাই, নারী ও শিশু নির্যাতন, অপহরণের মতো অপরাধও বেড়েছে। জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৩৬৬টি ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে ফেব্রুয়ারিতে সর্বাধিক ৭৪টি। নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ১১,০০৮টি, সবচেয়ে বেশি এপ্রিলে। এসব অপরাধের বিরুদ্ধে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সক্রিয়তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। অপরাধীদের ভয়ে সাধারণ মানুষ অনেক সময় এগিয়ে আসছেন না, ফলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ পাচ্ছে।
আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নে পুলিশ সদর দপ্তর আধিপত্য বিস্তারকারীদের তালিকা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে। পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম মনে করেন, রাজনৈতিক দলগুলোরও এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ বলেন, বিগত সময়ে কেয়ারটেকার সরকারের সময় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ছিল, কিন্তু বর্তমানে তা নেই। তিনি মনে করেন, দ্রুত একটি সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করে জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী সরকার গঠন করা জরুরি, যাতে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা যায়।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস) ইনামুল হক সাগর জানান, পুলিশ আন্তরিকভাবে অপরাধ প্রতিরোধে কাজ করছে এবং কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিচ্ছে। অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে কোনো ছাড় দেয়া হচ্ছে না। পাশাপাশি সামাজিক ও পারিবারিক অস্থিরতা থেকে বেরিয়ে আসার ওপরও গুরুত্বারোপ করেন তিনি। তার মতে, পারস্পরিক সহনশীলতা ও ধৈর্য জরুরি, এবং কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটলে আইন নিজের হাতে না নিয়ে পুলিশকে জানানো উচিত।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, মিটফোর্ডের ব্যবসায়ী হত্যাকাণ্ড অত্যন্ত দুঃখজনক। ইতোমধ্যে এ ঘটনায় পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কোনোভাবেই নির্লিপ্ত নয়; কিছু ক্ষেত্রে দেরি হলেও প্রতিটি ঘটনায় দ্রুত অ্যাকশনে যাচ্ছে।
সব মিলিয়ে, অপরাধের গ্রাফ ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে অস্থিরতা বাড়ছে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি সমাজের সকল সচেতন নাগরিকেরও দায়িত্ব রয়েছে।
মন্তব্য করুন