ঢাকা শনিবার, ১২ জুলাই ২০২৫, ২৮ আষাঢ় ১৪৩২
মুক্ত মনমুক্ত চিন্তামুক্তি গাথা

১০ জুলাই ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের গতিধারা ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

প্রিয়ভূমি প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১০ জুলাই ২০২৫, ১২:৫০ পিএম
১০ জুলাই ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের গতিধারা ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

১৯৭১ সালের ১০ জুলাই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিন। এদিন দেশ-বিদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কূটনৈতিক, সামরিক ও মানবিক প্রয়াস তীব্রতর হয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা আক্রমণ, আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের স্বীকৃতির দাবি এবং শরণার্থীদের সহায়তায় বৈশ্বিক সম্প্রদায়ের উদ্যোগ—এই দিনের ঘটনাবলি মুক্তিযুদ্ধের গতিপথকে আরও সুদৃঢ় করে।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন

কানাডার অবস্থান ও ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আলোচনা

১০ জুলাই দিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে কানাডার সংসদীয় প্রতিনিধিদল সাক্ষাৎ করেন। কানাডার প্রতিনিধিরা পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের সহায়তা বৃদ্ধির আশ্বাস দেন এবং পাকিস্তানের বিভক্তিকে "অনিবার্য বাস্তবতা" বলে উল্লেখ করেন। তারা ইন্দিরাকে জানান, "বাংলাদেশ আজ একটি বাস্তব সত্য," এবং শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার দাবিকে ন্যায্য বলে অভিহিত করেন। এদিনই কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিচেল শার্প গ্লোব অ্যান্ড মেইল পত্রিকায় একটি সাক্ষাৎকারে বলেন, "পাকিস্তানের বিভক্তি হয়তো কঠিন সিদ্ধান্ত, কিন্তু এটি এখন একমাত্র সমাধান।"

ভেনিজুয়েলা ও ব্রিটেনের প্রতিক্রিয়া

  • ভেনিজুয়েলার কারাকাস থেকে প্রকাশিত দ্য রিলিজিয়ন পত্রিকায় পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতাকে "যীশু খ্রিস্টও ক্ষমা করতেন না" বলে নিন্দা করা হয়।

  • যুক্তরাজ্যতে বাংলাদেশের শরণার্থীদের সহায়তায় ভারতীয় ক্রিকেট দলের সদস্যদের স্বাক্ষরিত একটি ব্যাট ৭৭ পাউন্ডে বিক্রি হয়।

মুক্তিবাহিনীর অভিযান: গেরিলা যুদ্ধের তীব্রতা

১০ জুলাই মুক্তিবাহিনী সারা দেশে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে একাধিক সফল অপারেশন পরিচালনা করে:

কুমিল্লার যুদ্ধ

  • শালদা নদীর মঈনপুরে সুবেদার আব্দুল ওয়াহাব (পরবর্তীতে বীর বিক্রম) এর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি স্পিডবোট অ্যামবুশ করে। এতে ক্যাপ্টেন বোখারি (কুমিল্লার জল্লাদ নামে কুখ্যাত) সহ ১২ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। পাকিস্তানি বাহিনী ওয়াহাবের মৃতদেহ উদ্ধারকারীকে ৫০,০০০ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে।

  • সাগরতলীতে মুক্তিবাহিনীর মর্টার ও মেশিনগান হামলায় ৪০ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়।

ঢাকায় গেরিলা আক্রমণ

ধানমণ্ডি ২ নম্বর সড়কে ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলারা পুলিশের ওপর গ্রেনেড হামলা চালায়। এতে ১ পুলিশ অফিসারসহ ৫ জন নিহত হয়।

নওগাঁর মধইলে আক্রমণ

মকাই চৌধুরীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের ওপর অতর্কিত হামলা চালিয়ে ৬ জনকে হত্যা করে।

প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রস্তুতি

কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার ১১-১৭ জুলাই সাত দিনব্যাপী সেক্টর কমান্ডার সম্মেলনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে। এ সম্মেলনে মুক্তিবাহিনীর উচ্চপদস্থ কমান্ডার ও ভারতীয় সেনা কর্মকর্তারা অংশ নেন।

পাকিস্তানের প্রচারণা ও ভেতরের চিত্র

  • পূর্ব পাকিস্তান রেডক্রসের প্রধান বিচারপতি নুরুল ইসলাম পাকিস্তানের পক্ষে প্রচার করতে ইউরোপ ও আমেরিকা সফর শেষে ঢাকায় ফেরেন।

  • দ্য ইকোনমিস্ট রিপোর্ট করে, পাকিস্তানি বাহিনী নিয়ন্ত্রণে থাকলেও মুক্তিবাহিনী সীমান্ত অঞ্চলে সক্রিয়। কুমিল্লা, নোয়াখালী, মধুপুরে গেরিলারা রেল ও সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে।

  • ঢাকায় বিদ্যুৎকেন্দ্রে হামলার পর শহর অন্ধকারে ডুবে যায়।

ভারতে শরণার্থী ও বিক্ষোভ

  • কলকাতায় বাংলাদেশি শরণার্থীরা মার্কিন উপদূতাবাসের সামনে পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করে।

  • নদীয়ার কৃষ্ণনগরে ভারতীয় নৌবাহিনীর কমান্ডোরা মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ দেয়।

উপসংহার

১০ জুলাই ১৯৭১-এর ঘটনাবলি মুক্তিযুদ্ধের বৈশ্বিক স্বীকৃতি ও গেরিলা যুদ্ধের গতিশীলতাকে তুলে ধরে। আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন বাড়লেও পাকিস্তানি বাহিনীর দমননীতি অব্যাহত থাকে। এই দিনটি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি স্তম্ভ হিসেবে চিহ্নিত।

তথ্যসূত্র ১. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র (ষষ্ঠ, সপ্তম, দশম, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড)। ২. দৈনিক পাকিস্তান, ১১ জুলাই ১৯৭১। ৩. দ্য ইকোনমিস্ট, ১০ জুলাই ১৯৭১। ৪. দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা, ১১ জুলাই ১৯৭১। ৫. আনন্দবাজার পত্রিকা (ভারত), ১১-১৪ জুলাই ১৯৭১। ৬. বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস (সেক্টর ২ ও ৭)।

অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

১২ জুলাই ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের রূপরেখা, রণনীতি ও কৌশল নির্ধারণে ঐতিহাসিক সেক্টর কমান্ডার্স সম্মেলন

১০ জুলাই ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের গতিধারা ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

৯ জুলাই ১৯৭১: আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও প্রতিরোধের গৌরব

সুরমা পুকুরপাড় গণহত্যা: আনোয়ারার রক্তাক্ত ৭ জুলাই ১৯৭১

সরিষাবাড়ি ও পাতপাড়া গ্রাম গণহত্যা: জামালপুরের বীরত্ব ও বেদনা

বান্দাইখাড়া গণহত্যা: নওগাঁর আত্রাইয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতা

বরুণা বাজার গণহত্যা: জুলাই ১৯৭১-এর নির্মম অধ্যায়

চেঁচুড়ি গণহত্যা: জুলাই-সেপ্টেম্বর ১৯৭১-এর নির্মম ঘটনাবলি

খলশি গণহত্যা: জুলাই-নভেম্বর ১৯৭১-এর এক নির্মম অধ্যায়

কালীনগর গণহত্যা: জুলাই ১৯৭১-এর এক নির্মম অধ্যায়

১০

৭ জুলাই ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের সিদ্ধান্তমুখর দিন

১১

মব ভায়োলেন্স প্রতিরোধে সদিচ্ছার অভাব

১২

মব সন্ত্রাসে অতিষ্ঠ দেশ

১৩

নারীশিক্ষা বনাম বাল্যবিয়ে

১৪

মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বনাম মব সন্ত্রাস

১৫

৫ জুলাই, ১৯৭১: মুজিবনগরে গণপ্রতিনিধিদের ঐতিহাসিক বৈঠক

১৬

২ জুলাই ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট

১৭

মিট্টিকুলাস পুলিশ হত্যা

১৮

১ জুলাই ১৯৭১: ইয়াহিয়া খানের প্রস্তাবিত রাজনৈতিক সমাধান প্রত্যাখ্যান

১৯

ধামুসা গণহত্যা (কালকিনি, মাদারীপুর)

২০