১৯৭১ সালের ১০ জুলাই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিন। এদিন দেশ-বিদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কূটনৈতিক, সামরিক ও মানবিক প্রয়াস তীব্রতর হয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা আক্রমণ, আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের স্বীকৃতির দাবি এবং শরণার্থীদের সহায়তায় বৈশ্বিক সম্প্রদায়ের উদ্যোগ—এই দিনের ঘটনাবলি মুক্তিযুদ্ধের গতিপথকে আরও সুদৃঢ় করে।
১০ জুলাই দিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে কানাডার সংসদীয় প্রতিনিধিদল সাক্ষাৎ করেন। কানাডার প্রতিনিধিরা পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের সহায়তা বৃদ্ধির আশ্বাস দেন এবং পাকিস্তানের বিভক্তিকে "অনিবার্য বাস্তবতা" বলে উল্লেখ করেন। তারা ইন্দিরাকে জানান, "বাংলাদেশ আজ একটি বাস্তব সত্য," এবং শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার দাবিকে ন্যায্য বলে অভিহিত করেন। এদিনই কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিচেল শার্প গ্লোব অ্যান্ড মেইল পত্রিকায় একটি সাক্ষাৎকারে বলেন, "পাকিস্তানের বিভক্তি হয়তো কঠিন সিদ্ধান্ত, কিন্তু এটি এখন একমাত্র সমাধান।"
ভেনিজুয়েলার কারাকাস থেকে প্রকাশিত দ্য রিলিজিয়ন পত্রিকায় পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতাকে "যীশু খ্রিস্টও ক্ষমা করতেন না" বলে নিন্দা করা হয়।
যুক্তরাজ্যতে বাংলাদেশের শরণার্থীদের সহায়তায় ভারতীয় ক্রিকেট দলের সদস্যদের স্বাক্ষরিত একটি ব্যাট ৭৭ পাউন্ডে বিক্রি হয়।
১০ জুলাই মুক্তিবাহিনী সারা দেশে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে একাধিক সফল অপারেশন পরিচালনা করে:
শালদা নদীর মঈনপুরে সুবেদার আব্দুল ওয়াহাব (পরবর্তীতে বীর বিক্রম) এর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি স্পিডবোট অ্যামবুশ করে। এতে ক্যাপ্টেন বোখারি (কুমিল্লার জল্লাদ নামে কুখ্যাত) সহ ১২ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। পাকিস্তানি বাহিনী ওয়াহাবের মৃতদেহ উদ্ধারকারীকে ৫০,০০০ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে।
সাগরতলীতে মুক্তিবাহিনীর মর্টার ও মেশিনগান হামলায় ৪০ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়।
ধানমণ্ডি ২ নম্বর সড়কে ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলারা পুলিশের ওপর গ্রেনেড হামলা চালায়। এতে ১ পুলিশ অফিসারসহ ৫ জন নিহত হয়।
মকাই চৌধুরীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের ওপর অতর্কিত হামলা চালিয়ে ৬ জনকে হত্যা করে।
কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার ১১-১৭ জুলাই সাত দিনব্যাপী সেক্টর কমান্ডার সম্মেলনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে। এ সম্মেলনে মুক্তিবাহিনীর উচ্চপদস্থ কমান্ডার ও ভারতীয় সেনা কর্মকর্তারা অংশ নেন।
পূর্ব পাকিস্তান রেডক্রসের প্রধান বিচারপতি নুরুল ইসলাম পাকিস্তানের পক্ষে প্রচার করতে ইউরোপ ও আমেরিকা সফর শেষে ঢাকায় ফেরেন।
দ্য ইকোনমিস্ট রিপোর্ট করে, পাকিস্তানি বাহিনী নিয়ন্ত্রণে থাকলেও মুক্তিবাহিনী সীমান্ত অঞ্চলে সক্রিয়। কুমিল্লা, নোয়াখালী, মধুপুরে গেরিলারা রেল ও সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে।
ঢাকায় বিদ্যুৎকেন্দ্রে হামলার পর শহর অন্ধকারে ডুবে যায়।
কলকাতায় বাংলাদেশি শরণার্থীরা মার্কিন উপদূতাবাসের সামনে পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করে।
নদীয়ার কৃষ্ণনগরে ভারতীয় নৌবাহিনীর কমান্ডোরা মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ দেয়।
১০ জুলাই ১৯৭১-এর ঘটনাবলি মুক্তিযুদ্ধের বৈশ্বিক স্বীকৃতি ও গেরিলা যুদ্ধের গতিশীলতাকে তুলে ধরে। আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন বাড়লেও পাকিস্তানি বাহিনীর দমননীতি অব্যাহত থাকে। এই দিনটি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি স্তম্ভ হিসেবে চিহ্নিত।
তথ্যসূত্র ১. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র (ষষ্ঠ, সপ্তম, দশম, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড)। ২. দৈনিক পাকিস্তান, ১১ জুলাই ১৯৭১। ৩. দ্য ইকোনমিস্ট, ১০ জুলাই ১৯৭১। ৪. দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা, ১১ জুলাই ১৯৭১। ৫. আনন্দবাজার পত্রিকা (ভারত), ১১-১৪ জুলাই ১৯৭১। ৬. বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস (সেক্টর ২ ও ৭)।
মন্তব্য করুন