ঢাকা শনিবার, ১২ জুলাই ২০২৫, ২৮ আষাঢ় ১৪৩২
মুক্ত মনমুক্ত চিন্তামুক্তি গাথা

৯ জুলাই ১৯৭১: আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও প্রতিরোধের গৌরব

প্রিয়ভূমি প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০৯ জুলাই ২০২৫, ১১:৪৪ এএম
৯ জুলাই ১৯৭১: আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও প্রতিরোধের গৌরব

১৯৭১ সালের ৯ জুলাই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিন। এদিন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পাকিস্তানের সমর্থনে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা, কানাডা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের অবস্থান, মুক্তিবাহিনীর সফল অভিযান এবং প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতা নানা দিক থেকে আলোচিত হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিচারিতা ও কিসিঞ্জারের রহস্যময় সফর

মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের প্রশাসন পাকিস্তানকে সমরাস্ত্র ও অর্থনৈতিক সাহায্য দেওয়া অব্যাহত রেখেছিল। সিআইএ-এর এক ব্রিফিংয়ে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতিকে "অচলাবস্থা" আখ্যা দিয়ে ভারতের সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপ নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের উদ্বেগের কথা উল্লেখ করা হয়। তবে, নিক্সন প্রশাসন পাকিস্তানের প্রতি তাদের সমর্থন থেকে সরে আসেনি।

এদিন পাকিস্তানের চিফ অব স্টাফ জেনারেল আব্দুল হামিদ খানের সঙ্গে বৈঠক করেন মার্কিন প্রেসিডেন্টের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার। বৈঠকে কিসিঞ্জার পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে মার্কিন সমর্থনের আশ্বাস দেন। তবে, হঠাৎ করেই কিসিঞ্জার অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং সরকারিভাবে জানানো হয় তিনি বিশ্রাম নিতে নাথিয়াগালি চলে গেছেন। পরবর্তীতে জানা যায়, তিনি গোপনে চীনের বেইজিংয়ে গিয়েছিলেন, যা পাকিস্তান-চীন-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি গোপন কূটনৈতিক সম্পর্কের ইঙ্গিত দেয়।

মার্কিন সিনেটর হিউ স্কট সেদিন স্বীকার করেন, "কংগ্রেসের চাপ সত্ত্বেও নিক্সন প্রশাসন পাকিস্তানকে সাহায্য বন্ধ করবে না।" তবে, ২৪ জন সিনেটর পাকিস্তানকে সাহায্য বন্ধের প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন। অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানকে অস্ত্র বিক্রি করে চীনের প্রভাব কাটিয়ে উঠা।

প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের কূটনৈতিক সাফল্য

মুজিবনগরে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের এক মুখপাত্র ৯ জুলাই ঘোষণা করেন যে, এখন থেকে বিদেশি সাংবাদিক ও নাগরিকদের মুক্তাঞ্চলে প্রবেশের জন্য বাংলাদেশ সরকারের অনুমতিপত্র (ভিসা) প্রয়োজন। ব্রিটিশ এমপি জন স্টোনহাউস ইতিমধ্যে কুষ্টিয়ার মুক্তাঞ্চলে যাওয়ার জন্য এই ভিসা সংগ্রহ করেছিলেন। এই ঘোষণা বাংলাদেশ সরকারের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল।

পাকিস্তানি সহযোগীদের অবস্থান

ঢাকায় নেজামে ইসলামের নেতা মওলানা আবদুল মতিন ও সৈয়দ মঞ্জুরুল আহসান এক যৌথ বিবৃতিতে বলেন, “পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য আমরা জীবন দিতেও প্রস্তুত। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে কোনো আপোষ হবে না।” এদিন ফুলপুরে ৬৫০ জন রাজাকারের প্রশিক্ষণ সমাপ্তি অনুষ্ঠান হয়, যেখানে ১৬০ জনকে সনদপত্র দেওয়া হয়।

আন্তর্জাতিক সমর্থন ও প্রতিবাদ

দিল্লিতে কানাডার সংসদ সদস্য অ্যান্ড্রু ব্রেউইন সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “কানাডা পাকিস্তানকে অস্ত্র বিক্রি বন্ধ করেছে। জাতিসংঘে বাংলাদেশের সংকট উপস্থাপন করা উচিত।” তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনসহ অন্যান্য দেশের প্রতি পাকিস্তানকে সামরিক সহায়তা বন্ধের আহ্বান জানান।

কলকাতায় বাংলাদেশের পক্ষে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়। বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম সহায়ক সমিতির নারী শাখা ও বাংলার চলচ্চিত্র শিল্পীরা মার্কিন দূতাবাসের সামনে পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান। সোভিয়েত দূতাবাসের সামনে ছাত্র-জনতা মার্কিন বিরোধী বিক্ষোভ করে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভারতের পাশে দাঁড়ানোর জন্য ধন্যবাদ জানায়।

মুক্তিবাহিনীর সফল অভিযান

মুক্তিযোদ্ধারা এদিন কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কয়েকটি সফল অপারেশন চালায়:

  • শালদা নদী অপারেশন: মেজর সালেকের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি সেনাদের ওপর মাইন বিস্ফোরণ ও মর্টার হামলা চালিয়ে ২৯ জন সেনাকে হতাহত করে।

  • বালুজুরি আক্রমণ: চৌদ্দগ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের হামলায় ৩০ পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়।

  • বটেশ্বর যুদ্ধ: পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করে মুক্তিবাহিনী ২৫ জন শত্রুসেনা হত্যা করে।

উপসংহার

৯ জুলাই ১৯৭১-এর ঘটনাবলি মুক্তিযুদ্ধের গতিপথকে আরও গতিশীল করেছিল। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পাকিস্তানের সমর্থক ও বিরোধী শিবিরের সক্রিয়তা, মুক্তিবাহিনীর বীরত্বপূর্ণ অভিযান এবং প্রবাসী সরকারের কূটনৈতিক সাফল্য এই দিনকে স্মরণীয় করে রেখেছে।

সূত্র

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র (তৃতীয়, অষ্টম, দশম, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড)

দৈনিক পাকিস্তান, ১০ জুলাই ১৯৭১

দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা, ১০ জুলাই ১৯৭১

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস (সেক্টর দুই)

ইত্তেফাক, ১০ ও ১১ জুলাই ১৯৭১

আনন্দবাজার পত্রিকা (ভারত), ১০ ও ১১ জুলাই ১৯৭১

রয়টার্স ও অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের প্রতিবেদন (৯ জুলাই ১৯৭১)

অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

১২ জুলাই ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের রূপরেখা, রণনীতি ও কৌশল নির্ধারণে ঐতিহাসিক সেক্টর কমান্ডার্স সম্মেলন

১০ জুলাই ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের গতিধারা ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

৯ জুলাই ১৯৭১: আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও প্রতিরোধের গৌরব

সুরমা পুকুরপাড় গণহত্যা: আনোয়ারার রক্তাক্ত ৭ জুলাই ১৯৭১

সরিষাবাড়ি ও পাতপাড়া গ্রাম গণহত্যা: জামালপুরের বীরত্ব ও বেদনা

বান্দাইখাড়া গণহত্যা: নওগাঁর আত্রাইয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতা

বরুণা বাজার গণহত্যা: জুলাই ১৯৭১-এর নির্মম অধ্যায়

চেঁচুড়ি গণহত্যা: জুলাই-সেপ্টেম্বর ১৯৭১-এর নির্মম ঘটনাবলি

খলশি গণহত্যা: জুলাই-নভেম্বর ১৯৭১-এর এক নির্মম অধ্যায়

কালীনগর গণহত্যা: জুলাই ১৯৭১-এর এক নির্মম অধ্যায়

১০

৭ জুলাই ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের সিদ্ধান্তমুখর দিন

১১

মব ভায়োলেন্স প্রতিরোধে সদিচ্ছার অভাব

১২

মব সন্ত্রাসে অতিষ্ঠ দেশ

১৩

নারীশিক্ষা বনাম বাল্যবিয়ে

১৪

মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বনাম মব সন্ত্রাস

১৫

৫ জুলাই, ১৯৭১: মুজিবনগরে গণপ্রতিনিধিদের ঐতিহাসিক বৈঠক

১৬

২ জুলাই ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট

১৭

মিট্টিকুলাস পুলিশ হত্যা

১৮

১ জুলাই ১৯৭১: ইয়াহিয়া খানের প্রস্তাবিত রাজনৈতিক সমাধান প্রত্যাখ্যান

১৯

ধামুসা গণহত্যা (কালকিনি, মাদারীপুর)

২০