ঢাকা শনিবার, ১২ জুলাই ২০২৫, ২৮ আষাঢ় ১৪৩২
মুক্ত মনমুক্ত চিন্তামুক্তি গাথা

১২ জুলাই ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের রূপরেখা, রণনীতি ও কৌশল নির্ধারণে ঐতিহাসিক সেক্টর কমান্ডার্স সম্মেলন

প্রিয়ভূমি প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১২ জুলাই ২০২৫, ১১:২৯ এএম
১২ জুলাই ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের রূপরেখা, রণনীতি ও কৌশল নির্ধারণে ঐতিহাসিক সেক্টর কমান্ডার্স সম্মেলন

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ১২ জুলাই একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এদিন কলকাতার ৮ থিয়েটার রোডে মুক্তিবাহিনীর সেক্টর কমান্ডারদের দ্বিতীয় দিনের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। গতকাল শুরু হওয়া এই সম্মেলনের প্রথম দিনের অস্বস্তি কাটিয়ে উঠে এদিন গভীর আলোচনা হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের রূপরেখা, রণনীতি ও কৌশল নিয়ে। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে এই সম্মেলনে মুক্তিযুদ্ধের সামরিক ও বেসামরিক নানা দিক নিয়ে বিস্তারিত পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।

সেক্টর কমান্ডারদের সম্মেলন: ঐক্য ও সমঝোতার আহ্বান

সম্মেলনের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ একটি আবেগঘন বক্তৃতা দেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধা ও বেসামরিক কর্মীদের ভূমিকার গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন, "মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করছেন এবং যাঁরা বেসামরিক নানা কাজে যুক্ত আছেন, সবার ভূমিকাই সমান গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি কাজই পরিপূরক।" তিনি দেশের বৃহত্তর স্বার্থে সবাইকে ঐক্য ও সমঝোতা বজায় রাখার আহ্বান জানান।

এই সম্মেলনে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের রূপরেখা, রণনীতি, কৌশল, নেতৃত্বের ধারা, এলাকা ভিত্তিক দায়িত্ব বণ্টন ইত্যাদি বিষয়ে গভীর আলোচনা হয়। সেক্টর কমান্ডাররা তাদের নিজ নিজ অঞ্চলের সাফল্য, সমস্যা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা উপস্থাপন করেন। তবে কিছু সেক্টর কমান্ডার মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে পাঠানো নীতিনির্ধারণী চিঠি না পাওয়ায় যুদ্ধ পরিচালনার নীতিমালা নিয়ে বিতর্ক হয়।

সেক্টর কমান্ডার মেজর রফিকুল ইসলাম (বীর উত্তম) later recalled, "আলোচনা ভোরবেলা শুরু হয়ে শেষ হতো রাতে। প্রতিটি সেক্টর কমান্ডারই তাদের সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে বিস্তারিত বলেছিলেন।"

মুজিবনগর সরকারের ঘোষণা: পাকিস্তানি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বর্জনের আহ্বান

এদিন মুজিবনগর সরকার একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা জারি করে। পাকিস্তান সরকার কর্তৃক বাংলাদেশের বাজারে ছাড়া প্রতিরক্ষা সঞ্চয়পত্র, জাতীয় সঞ্চয়পত্র ও প্রাইজবন্ড না কেনার জন্য জনগণকে অনুরোধ জানানো হয়। এছাড়া পোস্টাল জীবন বীমার প্রিমিয়াম প্রদান থেকে বিরত থাকতে বলা হয়। এই ঘোষণার মাধ্যমে মুজিবনগর সরকার পাকিস্তানের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে অকার্যকর করে দেওয়ার চেষ্টা করে।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা

যুক্তরাষ্ট্রে বিক্ষোভ যুক্তরাষ্ট্রের বাল্টিমোর বন্দরে পাকিস্তানের জন্য অস্ত্রবাহী জাহাজ এমভি পদ্মার বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ সংঘটিত হয়। শতাধিক বিক্ষোভকারী জাহাজটির গতিরোধের চেষ্টা করেন। ইস্ট ওয়েস্ট শিপিং এজেন্সির ম্যানেজার ওয়াল্টার স্পাইয়েকার দাবি করেন, জাহাজে কোনো সামরিক সরঞ্জাম নেই। তবে বিক্ষোভকারীদের মুখপাত্র বিল ময়ার জানান, পরদিন গোপনে গোলাবারুদ ওঠানোর পরিকল্পনা রয়েছে।

জাতিসংঘে ভারতের প্রচেষ্টা জাতিসংঘে ভারতের রাষ্ট্রদূত সমর সেন মহাসচিব উ থান্টের সঙ্গে বাংলাদেশের শরণার্থী সংকট নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি শরণার্থীদের নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের জন্য রাজনৈতিক সমাধানের ওপর জোর দেন।

ভুট্টোর বিতর্কিত মন্তব্য পাকিস্তানের জুলফিকার আলী ভুট্টো ইরানে দেওয়া এক বক্তব্যে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব দিলেও পরবর্তীতে তিনি তা অস্বীকার করেন। জামায়াতে ইসলামীর নেতা মওদুদী ভুট্টোর এই বক্তব্যের নিন্দা জানিয়ে বলেন, "শেখ মুজিব ও তার দল পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল।"

ভারতের প্রতিরোধ প্রস্তুতি

ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রায় লোকসভায় জানান, পূর্ব ও পশ্চিম সীমান্তে সেনাবাহিনীর প্রহরা জোরদার করা হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং পাকিস্তানকে সাহায্য বন্ধের আহ্বান জানিয়ে বলেন, "৮ জুলাই পর্যন্ত ৬৭ লাখ ৩৩ হাজার শরণার্থী ভারতে প্রবেশ করেছে।" স্বাস্থ্যমন্ত্রী অমিয়কুমার কিস্কু জানান, ১,১৪০ জন শরণার্থী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় মারা গেছেন।

মুক্তিযুদ্ধের মাঠে অগ্রগতি

  • টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে কাদেরিয়া বাহিনীর সাথে পাকিস্তানি সেনাদের সংঘর্ষে ৪ জন হানাদার সেনা নিহত হয়।

  • সিলেটের এনায়েতপুরে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনী ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়।

  • নওগাঁয় মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পাকিস্তানি বাহিনীর তীব্র যুদ্ধ হয়।

১২ জুলাই ১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধের সংগঠন ও কৌশলগত পরিকল্পনার দিক থেকে একটি ঐতিহাসিক দিন। সেক্টর কমান্ডারদের সম্মেলন, মুজিবনগর সরকারের অর্থনৈতিক নীতি, আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের প্রচেষ্টা এবং মাঠে মুক্তিবাহিনীর সাফল্য—সব মিলিয়ে এই দিনটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের গতিপথকে আরও সুদৃঢ় করে।

সূত্র

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস (সেক্টর ২)

লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে – মেজর রফিকুল ইসলাম (আগামী প্রকাশনী, ২০০৬)

দৈনিক ইত্তেফাক, ১৩ ও ১৪ জুলাই ১৯৭১

দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা (ভারত), ১৩ ও ১৪ জুলাই ১৯৭১

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র (অষ্টম, নবম, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড)

অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

১২ জুলাই ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের রূপরেখা, রণনীতি ও কৌশল নির্ধারণে ঐতিহাসিক সেক্টর কমান্ডার্স সম্মেলন

১০ জুলাই ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের গতিধারা ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

৯ জুলাই ১৯৭১: আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও প্রতিরোধের গৌরব

সুরমা পুকুরপাড় গণহত্যা: আনোয়ারার রক্তাক্ত ৭ জুলাই ১৯৭১

সরিষাবাড়ি ও পাতপাড়া গ্রাম গণহত্যা: জামালপুরের বীরত্ব ও বেদনা

বান্দাইখাড়া গণহত্যা: নওগাঁর আত্রাইয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতা

বরুণা বাজার গণহত্যা: জুলাই ১৯৭১-এর নির্মম অধ্যায়

চেঁচুড়ি গণহত্যা: জুলাই-সেপ্টেম্বর ১৯৭১-এর নির্মম ঘটনাবলি

খলশি গণহত্যা: জুলাই-নভেম্বর ১৯৭১-এর এক নির্মম অধ্যায়

কালীনগর গণহত্যা: জুলাই ১৯৭১-এর এক নির্মম অধ্যায়

১০

৭ জুলাই ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের সিদ্ধান্তমুখর দিন

১১

মব ভায়োলেন্স প্রতিরোধে সদিচ্ছার অভাব

১২

মব সন্ত্রাসে অতিষ্ঠ দেশ

১৩

নারীশিক্ষা বনাম বাল্যবিয়ে

১৪

মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বনাম মব সন্ত্রাস

১৫

৫ জুলাই, ১৯৭১: মুজিবনগরে গণপ্রতিনিধিদের ঐতিহাসিক বৈঠক

১৬

২ জুলাই ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট

১৭

মিট্টিকুলাস পুলিশ হত্যা

১৮

১ জুলাই ১৯৭১: ইয়াহিয়া খানের প্রস্তাবিত রাজনৈতিক সমাধান প্রত্যাখ্যান

১৯

ধামুসা গণহত্যা (কালকিনি, মাদারীপুর)

২০