সম্মেলনের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ একটি আবেগঘন বক্তৃতা দেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধা ও বেসামরিক কর্মীদের ভূমিকার গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন, "মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করছেন এবং যাঁরা বেসামরিক নানা কাজে যুক্ত আছেন, সবার ভূমিকাই সমান গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি কাজই পরিপূরক।" তিনি দেশের বৃহত্তর স্বার্থে সবাইকে ঐক্য ও সমঝোতা বজায় রাখার আহ্বান জানান।
এই সম্মেলনে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের রূপরেখা, রণনীতি, কৌশল, নেতৃত্বের ধারা, এলাকা ভিত্তিক দায়িত্ব বণ্টন ইত্যাদি বিষয়ে গভীর আলোচনা হয়। সেক্টর কমান্ডাররা তাদের নিজ নিজ অঞ্চলের সাফল্য, সমস্যা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা উপস্থাপন করেন। তবে কিছু সেক্টর কমান্ডার মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে পাঠানো নীতিনির্ধারণী চিঠি না পাওয়ায় যুদ্ধ পরিচালনার নীতিমালা নিয়ে বিতর্ক হয়।
সেক্টর কমান্ডার মেজর রফিকুল ইসলাম (বীর উত্তম) later recalled, "আলোচনা ভোরবেলা শুরু হয়ে শেষ হতো রাতে। প্রতিটি সেক্টর কমান্ডারই তাদের সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে বিস্তারিত বলেছিলেন।"
এদিন মুজিবনগর সরকার একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা জারি করে। পাকিস্তান সরকার কর্তৃক বাংলাদেশের বাজারে ছাড়া প্রতিরক্ষা সঞ্চয়পত্র, জাতীয় সঞ্চয়পত্র ও প্রাইজবন্ড না কেনার জন্য জনগণকে অনুরোধ জানানো হয়। এছাড়া পোস্টাল জীবন বীমার প্রিমিয়াম প্রদান থেকে বিরত থাকতে বলা হয়। এই ঘোষণার মাধ্যমে মুজিবনগর সরকার পাকিস্তানের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে অকার্যকর করে দেওয়ার চেষ্টা করে।
যুক্তরাষ্ট্রে বিক্ষোভ যুক্তরাষ্ট্রের বাল্টিমোর বন্দরে পাকিস্তানের জন্য অস্ত্রবাহী জাহাজ এমভি পদ্মার বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ সংঘটিত হয়। শতাধিক বিক্ষোভকারী জাহাজটির গতিরোধের চেষ্টা করেন। ইস্ট ওয়েস্ট শিপিং এজেন্সির ম্যানেজার ওয়াল্টার স্পাইয়েকার দাবি করেন, জাহাজে কোনো সামরিক সরঞ্জাম নেই। তবে বিক্ষোভকারীদের মুখপাত্র বিল ময়ার জানান, পরদিন গোপনে গোলাবারুদ ওঠানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
জাতিসংঘে ভারতের প্রচেষ্টা জাতিসংঘে ভারতের রাষ্ট্রদূত সমর সেন মহাসচিব উ থান্টের সঙ্গে বাংলাদেশের শরণার্থী সংকট নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি শরণার্থীদের নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের জন্য রাজনৈতিক সমাধানের ওপর জোর দেন।
ভুট্টোর বিতর্কিত মন্তব্য পাকিস্তানের জুলফিকার আলী ভুট্টো ইরানে দেওয়া এক বক্তব্যে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব দিলেও পরবর্তীতে তিনি তা অস্বীকার করেন। জামায়াতে ইসলামীর নেতা মওদুদী ভুট্টোর এই বক্তব্যের নিন্দা জানিয়ে বলেন, "শেখ মুজিব ও তার দল পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল।"
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রায় লোকসভায় জানান, পূর্ব ও পশ্চিম সীমান্তে সেনাবাহিনীর প্রহরা জোরদার করা হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং পাকিস্তানকে সাহায্য বন্ধের আহ্বান জানিয়ে বলেন, "৮ জুলাই পর্যন্ত ৬৭ লাখ ৩৩ হাজার শরণার্থী ভারতে প্রবেশ করেছে।" স্বাস্থ্যমন্ত্রী অমিয়কুমার কিস্কু জানান, ১,১৪০ জন শরণার্থী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় মারা গেছেন।
টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে কাদেরিয়া বাহিনীর সাথে পাকিস্তানি সেনাদের সংঘর্ষে ৪ জন হানাদার সেনা নিহত হয়।
সিলেটের এনায়েতপুরে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনী ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়।
নওগাঁয় মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পাকিস্তানি বাহিনীর তীব্র যুদ্ধ হয়।
সূত্র
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস (সেক্টর ২)
লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে – মেজর রফিকুল ইসলাম (আগামী প্রকাশনী, ২০০৬)
দৈনিক ইত্তেফাক, ১৩ ও ১৪ জুলাই ১৯৭১
দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা (ভারত), ১৩ ও ১৪ জুলাই ১৯৭১
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র (অষ্টম, নবম, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড)
মন্তব্য করুন